বাংড়ি তিতি হাউড়ি শেষে ...
পর্ব : ১
মিশা ঘোষাল
============================
আমার এ পথ নদী আর অরণ্যের
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার এ পথ
পথ হারানোর
পথ হারিয়েও খুঁজে নিই এই পথ...
টোটোপাড়ার
এই পথের অনেক দিনের যাত্রী আমি। পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার ভূটান
সীমান্তে অবস্থিত দুর্গম একটি ছোট্ট জনপদ এই টোটোপাড়া গ্রাম, যেটি
টোটোপাড়া-বল্লালগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। আদিম উপজাতি টোটোদের
একমাত্র আবাসস্থল হল এই টোটোপাড়া গ্রাম। বন্ধুর পথ, এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা,
বিস্তীর্ণ এই ডলোমাইটের ধুলোমাখা পথ পার হতে গেলে পেরিয়ে যেতে হয় তিনটি
পাহাড়ি নদী - তিতি, বাংড়ি ও হাউড়ি। আরও অসংখ্য ছোট-বড়ো জলপ্রবাহের ঝোরা,
উপঝোরা মিলে মাদারীহাট থেকে টোটোপাড়ার এই দীর্ঘ বাইশ কিলোমিটার পথ পাড়ি
দেওয়া আসলে একটি রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাসের রসদ ! যার প্রতিটি পাতায় লেখা
থাকে বহু অভিজ্ঞতা, বহু রোমাঞ্চকর অনুভূতি, নদী-পথ পেরোনোর ঝুঁকি ও
সংগ্রাম। দীর্ঘ বারো বছর ধরে এই দুর্গম পথের যাত্রী আমি। অনেক
ঘাত-প্রতিঘাত সঙ্গী করে এই পথেই খুঁজে পেয়েছি আমার প্রাণ, আমার জীবন্ত
কবিতার সম্ভার! এবার 'সহজ উঠোনে' আমি বলব সেই যাওয়া, দিন-যাপন আর প্রতি
দিনের সঞ্চয়ের গল্প!
আমার কর্মস্থল "ধনপতি টোটো
মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়"টি যে এই টোটোপাড়াতেই অবস্থিত! এই বিদ্যালয়টি
একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয় টোটোপাড়ার, যেটি এখন উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত।
আমার এই যাত্রাপথে খেলা করে নির্জন অভয়ারণ্যের সবুজ আলো ও বাতাস। মনের
নির্জনে এসে প্রবেশ করে অরণ্যের ফিসফাস, ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ, পাখিদের
কিচিরমিচির আর খোলা হাওয়ার গান ।
মাদারিহাট থেকে টোটোপাড়ার এই বাইশ কিলোমিটার যাত্রাপথে দেখা মেলে তিন পাহাড়ি নদী- তিতি, বাংড়ি ও হাউড়ি ।
জলদাপাড়া
অভয়ারণ্যের গা ঘেসে বয়ে চলে প্রবল খরস্রোতা তোর্ষা নদী, যেটি ভূটান পাহাড়
থেকে সৃষ্টি হয়ে টোটোপাড়ার সীমানা দিয়ে বয়ে চলেছে। এই তোর্ষার পাড় ঘেঁষে
রয়েছে একটি রাস্তা - "ট্রলি লাইন"। শোনা যায় ব্রিটিশ আমলে এখানে দিয়ে ট্রেন
চলাচল করত। মালপত্র পরিবহনের রাস্তা ছিল এটি। তাই এটি "ট্রলি লাইন"।
এই পথে বর্তমানে একটি নজরমিনার ও অরণ্য- কুটির রয়েছে বন দপ্তরের।
আমাদের
মূল যাত্রাপথ হল তিতি, বাংড়ি, হাউড়ি ও অসংখ্য ঝোরা উপঝোরা পেরিয়ে জামতলা
বাজার, হান্টাপাড়া হয়ে বাঙড়ি নদীর পথ পেরিয়ে তিতির জঙ্গল পেরিয়ে হল্লাপাড়া
আর বল্লালগুড়ির রাস্তা ধরে হাউড়ি নদীর প্রকান্ড হা পেরোতে পেরোতে টোটোপাড়ায়
পৌঁছে যাওয়া।
টোটোপাড়ায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ঘুরে
ঘুরে বৃষ্টিও এখানে ঘুরপাক খায়। বৃষ্টির জলোচ্ছ্বাসে এই পথ প্রায়ই বন্ধ হয়ে
যায়। তখন আমারা বিদ্যালয়ে পৌঁছনোর জন্য বিভিন্ন ঘুরতি পথ অবলম্বন করে
টোটোপাড়া পৌঁছাই। "ট্রলি লাইন" হল এরকমই একটি পথ আমাদের। জলদাপাড়া
অভয়ারণ্যের ভিতর দিয়ে এই পথই হয় তখন আমাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার রাস্তা।
বন্ধুর পথ, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, তোর্ষার আওয়াজ ও নির্জন অরণ্যের চুপকথা মনের
তল্লাটে এক মায়াবী আলোর ঠিকানা লিখে রাখে। এ পথে বহুবার যেতে যেতে দেখা
পেয়েছি বাইসন, হরিণ ও দাঁতাল হাতির দলের সাথে হস্তি-শাবক। ময়ূরের নৃত্য ও
পেখম খুলে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমা দেখে এক মুহুর্তে মনের সবরকম চিন্তা
ভুলে যাওয়া যায়। এ এক অনন্য প্রাপ্তি এই যাত্রাপথের! বানরের দলের হুল্লোড় ও
পাখিদের কিচিরমিচিরে প্রাণ জুড়োয়। যাত্রাপথের ক্লান্তি ভুলে যাওয়া যায় এক
নিমেষে যখন সামনে পড়ে বালি-হাঁস, বক ও কাঠ-ঠোকরা, পাখির ঝাঁক! শাল, খয়ের,
চিকরাশিদের ভিড় থেকে ছুটে আসে দুরন্ত হাওয়া, মনে সবুজের আলো মেখে দেয়।
সেগুন গাছের পাতাগুলি হাতির কানের মতো দুলতে থাকে বাতাসে। পথের ধারে ফুটে
থাকা সাদা সাদা বুনোফুলগুলি উঁকি দিয়ে দেখে ! বুনো গন্ধে ভরপুর এই রাস্তায়
পড়ে থাকে বালি পাথরের চাঁই, স্রোতে ভেসে আসা গাছের গুঁড়ি, ডালপালা আর
লতাগুল্মের ঝাড় ।
রোমাঞ্চকর এই দুর্গম পথ, ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। কাজ শেষে আবার ফিরে আসি এই একই যাত্রা পথে বারবার...
টোটোপাড়াতেই যে ঠিকানা লেখা আমার !!