পইলা সাঞ্ঝির কথা/১
পইলা সাঞ্ঝির কথা
প্রথম পর্ব
শুক্লা রায়
~~~~~~~~~~
মুখবন্ধ
পইলা সাঞ্ঝি বা পইল সাঞ্ঝ হল অন্ধকার ঘন হয়ে ওঠার আগের সময়টুকু। শিরোনাম হিসেবে পইলা সাঞ্ঝিকে আক্ষরিক অর্থে নয় রূপক অর্থে নিয়েছি। আধুনিকতা প্রবলভাবে গ্রাস করার আগে আমাদের শৈশবস্থায় যে সহজ জীবন অতিক্রম করে আমরা বর্তমানে এসে পৌঁছেছি সেই জীবনের কথা টুকরো টুকরো লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রত্যেকটি পর্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধারাবাহিক হলেও এক পর্বের সঙ্গে আরেক পর্ব নির্ভরশীল নয়।
***************************************
বটেশ্বরী রাধা, শ্রীকৃষ্ণ পাকুড়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সকালবেলা বাইরের উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে বসমতী অবাক হল। কোণা-কাঞ্চিতে প্রচুর ছোট ছোট কদমের চারা। দেখে কেমন মায়া হল। একটু জায়গাবদল করে না পুঁতলে একটাও বাঁচবে না। হুজুগ উঠল মাথায়, ঝাঁটা ফেলে রেখে বাড়ি থেকে একটা ছোট ছেনি এনে কদমগুলো খুঁজে খুঁজে বেড়ার দিকে ঘেঁষে পুঁততে লাগল। পথফিরতি নৃপেন কান্ড দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। 'কাকি, কী এত খুঁড়াখুড়ি করিছিত?' বসমতী কদমগাছগুলোর কথা বলতে নৃপেন নিজেই এগিয়ে এসে ছেনিটা নিল হাতে। 'দ্যাও মোক, এই কয়টা গছ মুইয়ে গারি দ্যাং।' বসমতী বাধা দিল না। এটাই স্বাভাবিক এখানে। জিজ্ঞেস করল, 'কোটে গেসিস বাউ?' নৃপেন মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে জবাব দিল, 'মাচকিলা দেওয়ানির বাড়িত। কামলা বোলে নাগে, তে হইসে মানসি, মোক আর না নিল।' নৃপেনের গলায় একটা হতাশার সুর ভেসে ওঠে। 'আজি থাকে তিনদিন বসিনা আছোং কাকি। কাজে দেয় না কাহো। ছাওয়ায় ছোটে, বুড়া-বুড়ি, অনেকলায় না মানসি খাই।' ঠান্ডার দিন হলে তো ভাটাখানা গেলুং হয়। কেং করি যে দিনগিলা যাবে বারে।' বসমতীর মনে কষ্ট হয়। নৃপেনকে বাড়িতে ডেকে চা আর চালভাজা খেতে দেয়। নৃপেন অবশ্য অর্নগল কথা বলতেই থাকে। একমুঠ চালভাজা খেয়ে বাকিটা ঘাড়ের গামছাটায় বেঁধে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। তাই দেখে বসমতী ঘর থেকে আরো চালভাজা এনে ওর গামছায় ঢেলে দেয়। নৃপেন ওর খুশি লুকোতে পারে না। লাজুক কন্ঠে মৃদু আপত্তি দেখিয়ে বলে 'থাউক থাউক কাকি, এইলায় হবে। ছাওয়া তিনটা এলায় চবের পাবে কোনেক। নিগাও।' কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ওর যাওয়া হয়ে ওঠে না। হঠাৎ চোখ চলে যায় ছোট্ট দুটি চারা গাছে। বট ও পাকুড়ের দুটি চারা প্রায় পাশাপাশি গজিয়েছে। দেখেই ও লাফ দিয়ে উঠে বসমতীকে ডাকে, 'কাকি কাকি, আয় দেখি যা। তোমার বাড়িৎ কি গাজাইসে।' বসমতী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দেখে খুশীই হল। খুশী খুশী গলায় বলে ওঠে, 'দ্যাখোতো কেমন কান্ড, আপনে আইচ্চে, এলা তো পালি পুষি বিয়াও দিবারে নাগিবে। কী কইস বাপোই?' নৃপেন মাথা নেড়ে বলে, 'কাথাটাতো হয় কাকি। কিন্তুক মাচকিলা দেওয়ানীর বুড়িটা মেলা দিন থাকি চান্দে বেড়ায়। বট-পাকড়ি অ্যাকঠেকোনা। উমার ছোট বেটার ঘরৎ যে ছাওয়া-পাওয়া নাই বারে। মেলা ওঝা কবিরাজ গেইল। এলা টাউনোত বড় দাক্তারেট্টে দোনোটা মানষিয়ে মাসে মাসে যায়।' একটু থেমে বলে, 'বট-পাকড়ির বিয়াও দিলে বোলে বাচ্চা-কাচ্চা হয় কাকি?' তারপর হতাশ সুরে বলে হামরা খোবার পাইনা, মোর তিনটা ছাওয়া, উমরা দেওয়ানি মানষি, উমার আরো নাই। ভগবানের বিচারটা দ্যাখ তো তুই।' তারপর সরাসরি বসমতীকে প্রশ্ন করে, 'কী তে দিবু, না নিজে পুজিবু?' বসমতী একটুও আপত্তি না করে রাজী হয়ে যায়। ভালোই হল। দেওয়ানি বাড়ি পুজো করলে গোটা গ্রাম জুড়ে উৎসব হবে। নৃপেন বসমতীকে বলে 'ভুবুরা চাইট্টা বাড়িৎ দিয়া আসিয়া যাং।'
মেজো দেওয়ানি নিজেও বট-পাকুড়ের মাহাত্মকে খুব বিশ্বাস করেন। শুনেই জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। বট-পাকুড়ের বিয়ে দিলে অনেক পুণ্য অর্জন হয়। সন্তানহীন দম্পতি সন্তান কামনায়, আবার পরজন্মে রাধা-কৃষ্ণকে ছেলে-বৌমা রূপে পেতেও অনেকে বট-পাকুড়ের বিয়ে দেন। দেওয়ানি নৃপেনকেই হুকুম করলেন, 'এত ভালো খবরটা আনিলু, তে তুইয়ে কোনেক যা তো বাপোই, ঠাকুরটাক খবর দিয়া একেবারে ধরি আয়। 'এখানে দু'তিন ঘর অসমিয়া ব্রাহ্মণের বাস। রাজবংশী সমাজের পুজো-আচ্চা, বিয়ে-টিয়ে এই অসমিয়া ব্রাহ্মণই পুরোহিতের দায়িত্ব পান। দেওয়ানির বাড়িতে ডাক পেয়ে ফুকন দেব শর্মা খুশি হলেন।
পঞ্জিকায় শুভদিন দেখে ঢাক বাজিয়ে পুজো করে বসমতীর বাড়ি থেকে বটেশ্বরী শ্রীরাধা এবং শ্রীকৃষ্ণ পাকুড় চললেন দেওয়ানি বাড়ির পশ্চিমের প্রাইমারী স্কুল মাঠে। স্কুলের জমিও বুড়ো দেওয়ানির দান করা। যত্ন করে গাছগুলো পুঁতে নিয়মিত সকালে গাছের গোড়াটা লেপা-পোঁছা আর সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা হল। একটু দূরে বসানো হল মিতবর স্বরূপ কদম্ব গাছ। জায়গাটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল। এই গাছ পুজো আসলে প্রকৃতির পুজো। এরপর অপেক্ষা গাছগুলো বড় হলে বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ের প্রায় সব আচার এখানে পালন করা হয়। বরপক্ষ, কনেপক্ষ, এমনকি জলছিটাও থাকেন একজন। এই বিয়েতে দিব্বি বেয়াই-বিয়ান এবং জলছিটার সঙ্গে আমাদের রাজবংশী সম্পর্ক 'সোঙরা', 'সুঙরি' আত্মীয়তায় জড়িয়ে পড়েন। বসমতীর খুব ইচ্ছে ছিল অন্তত জলটা ছিটায়। কিন্তু বলতে সাহস হয়নি। 'চাতাল' আলাদা হলেও তিন দেওয়ানির মিলমিশ খুব। বট-পাকুড়ের বিয়ের আগে গ্রামজুড়ে বিরাট পুজোর আয়োজন হল। মনসা পুজো চলল পুরো পনেরো দিন ধরে। পালাগান শেষে খিচুড়ি প্রসাদ। কালি, চন্ডী, বিষহরি সবপুজো একসঙ্গে চলল ধুমধাম করে।
আসলে রাজবংশী সমাজের এই একটা নিয়ম। বাড়িতে বিয়ে, ভাত ছোঁয়ানী বা অন্নপ্রাশনে যার যেমন সামর্থ্য পুজোগুলো করতেই হয়। তাই কেউ একদিনে, কেউ তিনদিনে, কেউ পাঁচদিনে, পনেরো বা একমাস ধরে পুজো করে। এর সঙ্গে চলল বট-পাকুড়ের বিয়ের প্রস্তুতি। বিয়ে দেবে মেজো দেওয়ানীর ছোটবেটা-বউ। ওরা দুজনই সব পুজো করছে। তবে বিয়েতে কনেপক্ষ ও পাত্রপক্ষ লাগে বলে বড় দেওয়ানীর শ্বশুরবাড়ির তরফের কেউ কনেপক্ষ হচ্ছে। জলছিটা কে হল বসমতী এখনও শোনেনি। এই ক'দিন টানা উপোস চলছে প্রায়। এই পুজা, সেই পুজা করে। গলায় নতুন গামছা জড়িয়ে অনবরত সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। বটগাছের গায়ে যত্ন করে লালপেড়ে সাদা সুতির কোড়া শাড়ি জড়ানো, পাকুরের গায়ে কোড়া ধুতি। ঢাকের আওয়াজে কান ঝালাপালা। বিয়ের দিন প্রায় গোটা পাড়ার মেয়ে-বউ, বাচ্চা-কাচ্চা গ্রাম পুজোয় বের হল। গ্রামের একমাত্র নদীটিকে পুজো দিয়ে কলার 'ঢোনায়'(কলার খোলের তৈরী) প্রসাদ ফুল বেলপাতা ভাসিয়ে নদী থেকে ঘড়ায় করে জল নিয়ে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে বিভিন্ন 'থান' -এ পুজো দিয়ে তবে ফিরল। মানুষের বিয়েতেও এই গ্রাম পুজো এবং জল 'বরণ' করে আনতে হয়। সেই জলেই স্নান করিয়ে দেওয়া হয় কনে অথবা বরকে। বট-পাকুড়ের বিয়ে আসলে তো কোনো মানুষের বিয়ে নয়। দেবতাকে বিয়ে দেওয়ার ছলে পুজো এবং মনোস্কামনা জানানো। তবে নিয়ম আচারের কোন ত্রুটি নেই। বসমতী বড় হুজুগে মানুষ। এই ক'দিন বাড়ি ঘর ভুলে পুজোর আনন্দে কাটিয়ে দিল। অবশ্য বসমতী একা নয়। এইসব পাড়া-গাঁয়ে আনন্দের আয়োজন এমনিতেই খুব সামান্য। ব্যবসা-বানিজ্যের যোগ না থাকায় শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভরশীল সমাজের বেশীরভাগ মানুষই দারিদ্র্যের সঙ্গে নিত্য যুদ্ধে বিধ্বস্ত। দেওয়ানি বাড়ির এই পুজো উপলক্ষ্যে অঢেল খাওয়ার আয়োজন, বিষহরা পালা-গান, সবাই কয়েকটা দিন নিজের অবস্থা ভুলে আনন্দে ভেসে বেড়ালো।
"""""""""'''""""""""""""""""""""""'''""""""""""""""""""""""'''""""""""
শব্দ পরিচিতি ঃ- মাচকিলা - মেজো, ভাটাখানা - ইঁট ভাটা, ভুবুরা - চালভাজা, জলছিটা - এটা একটা সম্মানজনক বিশেষ আচার, বিয়েতে মন্ডপের ঘট থেকে আমের পল্লব থেকে জল নিয়ে বর-কনে
কে মেয়ে-জামাই অথবা ছেলে-বৌমা বানাতে মাথায় ছিটিয়ে দেন গুরুজন কেউ, এর ফলে একটা নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়। সোঙরা-সুঙরি - আসল বাবা-মা এবং বর-কনের জলছিটা বাবা-মা পরস্পরকে সোঙরা এবং সুঙরি সম্বোধন করেন। থান- দেবতা যেখানে অধিষ্ঠান করেন, মন্দির।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴