নানারঙের গানগুলি/১
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমি গানের ব্যকরণ জানি না। স্রেফ অদীক্ষিত শ্রোতা। আর কন্ঠে সুর? যদি বা কখনো বাড়িতে গুনগুন করার চেষ্টা করি, মেয়ে বৌ রক্ষা চায়! হ্যাঁ, নিতান্তই অ-সুর বলা যেতে পারে, এ সত্যিটা স্বীকার করতে লজ্জা পাই না।
তবে, কিছু কিছু গান, কখনো পুরোটাও নয়, কয়েকটি কলি, কানের ভেতর দিয়ে সত্যিই মরমে পৌঁছে যায় এ হেন আমারও। শুনতে ভালোবাসি। এবং ঘরানা, ধারা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাছ বিচারও করি না। তেমনই কিছু ভালো লাগা গান নিয়ে কথকতায় সাহসী হলাম। এই অনধিকার চর্চার জন্য যাঁরা দয়া করে পড়বেন, তাঁদের কাছে শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে রাখি।
আমাদের জীবনে, প্রতি ক্ষণের বয়ে চলায়, শেষের সে দিনের অপেক্ষায়, যিনি আমার প্রতিটি পলে জড়িয়ে, তাঁরই কিছু গান ছাড়া 'শুরু' হয় না। সাথে, সে সব গানের অনুষঙ্গে আমার কিছু কথা। আগেও হয়তো লিখেছি এমন, টুকরো টুকরো ছবিতে, আজ মেলানোর চেষ্টা। তাঁর গান কি কেবল তাঁরই গান, যে প্রেক্ষিতে লিখেছিলেন, সুর বেঁধেছিলেন? নাকি আমাদেরও? সুরে, ব্যক্তিগত বিশ্লেষণে?
অনেক ছোটোবেলার কথা যদি ধরি, ভেসে তো আসে স্কুল এসেম্বলির সেই "জনগণমনঅধিনায়ক ভারত ভাগ্যবিধাতা"! অর্থ বুঝি না-বুঝি, তারস্বরে দিদিমনিদের সাথে গলা মেলানোর চেষ্টা! তারও পর উঁচু স্কুলে "আমার সোনার বাংলা " অথবা "ও আমার দেশের মাটি"।
কিন্তু, এসবই তো রুটিনগান, যেমন ফার্স্ট পিরিয়ডে বাংলা, তাপ্পর অংক, তেমনি, স্কুলে পৌঁছনোর পর প্রথম 'কাজ'। হঠাৎই এই সময় দিয়ে কানে পৌঁছলো, "কোন বনের হরিণ ছিলো আমার মনে!" তার পর থেকে অন্বেষণ, কোথায় হারালো সেই হরিণী, কে তারে বাঁধলো অকারণে! খুঁজে পাওয়া হ'ল না আর, এত দিনেও। তবু সে মায়াহরিণী রয়েই গেল বুকের ভেতর, একাফাঁকা দুপুরে কোথা থেকে যেন তার কস্তুরিবাসটুকুও ভেসে আসে। বস্তুত এই চলনটির মারফৎই রবীন্দ্রগানের সাথে আমার পরিচয়প্রিয়ত্ব।
এর পর একলা থাকার প্রিয় কৈশোর। ল্যাকপেকে আমি, তালপাতার সেপাই, খেলায় তত চোস্ত নই, তাই বই মুখে জানালার ধারে, অথবা সিঁড়ির ধাপে। পড়তে পড়তে কখন যে বই বন্ধ করে দিই, আর অমল হয়ে যাই ! দইওয়ালা একা নয়, কত ওয়ালাই তো চলে যায় পথের সুমুখ দিয়া, হয়তো মেঘের ছদ্মবেশে সুধারাও ফুল কুড়িয়ে ফেরে, আমার মনপ্রাণ উদগ্রীব হয়ে থাকে কখন যে দোতলার সীমা কাকীমার এল.পি থেকে ভেসে আসবে মেঘলাজাদুর সেই কন্ঠ, "ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে" অথবা "আছি এক ঠাঁই, সে কথা যে যাই পাসরি!"
বাইরের রাস্তায় পা রাখা, এমন কি বেপথুও হতে থাকা স্কুল ছাড়ানোর তালে তালে। কিন্তু ঐ একলা থাকার অভ্যেসটি তবু রয়ে যায়। প্রয়োজনীয়তা ছাড়া। অপ্রয়োজনের এমনই কোনো আড্ডা সেরে বাড়ি ফেরার চেনা রাস্তায় ঝড় ওঠে। আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি। চমকে চমকে ওঠা বিদ্যুতের ঝলসে স্টেশন রোডের চেনা পথটাও কেমন উজ্জ্বয়িনীপুর হয়ে ওঠে। পা-মাথা-হৃদয় ভিজে চুপচুপ তরুণটির ঈষৎ প্রভাবিত বেসুরো গলায় বেজে ওঠে,
"তিমিরময় নিবিড় নিশা
নাহি রে নাহি দিশা
একেলা ঘনঘোর পথ
পান্থ কোথা যাও........"
আর এমন চাপাছায়ার দিনে, অলস শুয়ে থাকার দিনে, যে সব দিনে মনে হতে থাকে দিনের দীপ্তি যেন তার বরাদ্দ সময়েরও অনেক আগে নিভে যাচ্ছে, তখনও আর এক প্রিয় গান শোনান তিনি,
" বহুযুগের বাক্যরাশি
এক নিমেষে যাবে ভাসি
একলা বসে শুনবো বাঁশি
অকূল তিমিরে
এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবি রে.....৷"
রবিঠাকুরের গান ছাড়া 'শুরু' হয় না। অন্তত আমার। ছোটোবেলার ঘরের ভেতর একলাটেরে দিনগুলোতে তেমন ভাবে গান পায় নি আমাকে। স্কুলের উঁচু ক্লাসেই বাইরের রাস্তায় পা রাখা, এমন কি বেপথুও হতে থাকা স্কুল ছাড়ানোর তালে তালে। কিন্তু ঐ একলা থাকার অভ্যেসটি তবু রয়ে যায়। প্রয়োজনীয়তা ছাড়া। অপ্রয়োজনের এমনই কোনো আড্ডা সেরে বাড়ি ফেরার চেনা রাস্তায় ঝড় ওঠে। আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি। চমকে চমকে ওঠা বিদ্যুতের ঝলসে স্টেশন রোডের চেনা পথটাও কেমন উজ্জ্বয়িনীপুর হয়ে ওঠে। পা-মাথা-হৃদয় ভিজে চুপচুপ তরুণটির ঈষৎ প্রভাবিত বেসুরো গলায় বেজে ওঠে,
"তিমিরময় নিবিড় নিশা
নাহি রে নাহি দিশা
একেলা ঘনঘোর পথ
পান্থ কোথা যাও........।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴