দাঁড়াবার জায়গা/পর্ব : ১
সমর দেব
===========
এখনও বেশ মনে আছে। সেটা ছিল এক প্রবল শীতের রাত।
আমাদের শৈশব, কৈশোরে কোচবিহারে তখন রাতের তাপমাত্রা হয়ত শূন্যাঙ্কের কাছাকাছি নেমে যেত। অসহনীয় সেই ঠান্ডায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমরা সকাল সন্ধ্যায় প্রায়ই আগুন পোহাতাম। গাছের শুকনো পাতা, কখনো শুকনো ডাল, কখনও খড় দিয়ে জ্বালানো হতো সেই আগুন। আমাদের শীতের পোশাক প্রায় কখনই তেমন থাকত না। আর, প্রবল ঠান্ডায় জড়োসড়ো আমরা সেই আগুন ঘিরে বসতাম। সকলের হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরা। খুব বেশিক্ষণ ওভাবে বসা যেত না। ফলে, মাঝেমাঝেই উঠতে হতো, কখনও আগুনের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতাম আমরা। বড়দের কেউ কেউ বাধা দিত, কারণ, ‘পিঠ সেঁকা যায় না’। কিন্তু আমরা প্রায়ই কেউই সেই নিষেধাজ্ঞা তেমন কানে তুলিনি। আগুন ঘিরে সেই মনোরম জলসায় পাড়ার নানা বয়সীরা প্রায়ই জড়ো হতো। কখনও আমাদের বাড়িতে আগুন জ্বালানো হতো, কখনও পাশের বাড়িতে বা তার পরের বাড়িতে। সেই আগুনের চারপাশ ঘিরে জমে উঠত কত কথা। সেসব কথা প্রায়ই হাসি-মস্করার। কেউ কেউ পাড়ারই কাউকে নিয়ে হয়ত ক্যারিকেচার করছে, আর সকলে হেসে লুটিয়ে পড়ছে। বড়দের কারো কারো মুখে কখনও শুনেছি পরনিন্দা, পরচর্চাও। আমাদের সামনেই সেসব চলত। ফলে, আমাদের বয়সের পক্ষে অশ্রাব্য অনেক কথা, অনেক গল্প আমাদের কানেও পৌঁছত। আমরা নিশ্চয়ই সেসব বুঝতাম না, কিন্তু প্রায়ই গিলতামও সেসব!
যেদিনের কথা মনে পড়ছে, সেটা ছিল শীতের রাত। রাতের স্তব্ধতা খানখান করে ক্রমশ, গোপন এক ষড়যন্ত্রীর মতো, সম্ভবত ঘরের কাছেই আমগাছের ডালে বসে ডাকতে থাকলো একটা প্যাঁচা। কোঁক, কোঁক, কোঁক, যেন এক অনন্ত বিনাশী অলাতচক্র, অবিরত ঘূর্ণনের বলয়গ্রাস। তখন আকাশ কাঁদছিল বোধহয়। থমকে গিয়েছিল শীতের হিমেল বাতাস। প্রবল শীতের রাতে ভয়ে জড়োসড়ো, সে এক বালকবেলা, বালখিল্য ত্রাসে থরহরি কম্পমান পেলব হৃদয়। সন্ধ্যায় একটু দেরিতেই ন-দাদা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অস্ফূট বলেছিল, ‘পাটাকুড়া মোড়ে আমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যান’। কথাটা সে বলেছিল অনেকটা ফিসফিসিয়ে। কেন, কে জানে! মা আয়ত চোখ মেলে তাকিয়েছিল, কিছু বলেনি। মেজদি বলেছিল, ‘থাক থাক। খেয়ে শুয়ে পড়’।
তখন থেকেই কেন কে জানে, মেরুদণ্ডের গভীরে একটা শিরশিরানি, একটা শীতল অনুভব। আর, এই এত রাতে ‘বলো হরি, হরি বোল’, ‘বলো হরি, হরি বোল’, দূরে, বহুদূরে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুমুল চিৎকার। শীতের রাত, সময়টা ষাটের দশকের শেষ অথবা সাতের দশকের শুরু। যদুবাবুর স্কুলের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণি। যদুবাবুর স্কুল কত্ত দূরে, রোজ ছোড়দি শ্যামা আর পাড়ার আরও কয়েকজনের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যাওয়া আসা। কারণ, ততদিনে কারো হাত ধরে স্কুলে পৌঁছনোর পর্ব মিটে গেছে। এখনও চোখে ভাসে পথের পাশে বন্ধ দোকানের ঝাঁপের টিনের ওপরে আলকাতরায় লেখা ‘এক কানু পড়েছে ধরা, হাজার কানু দিয়েছে সাড়া’। উচ্চারণ করে পড়তে কী ভালো লাগে। চমৎকার ছন্দ আছে। শ্রবণে যেন একটা সাড়া পড়ে যায়। বারবার ক্রমাগত উচ্চারণে মস্তিষ্কের গভীরে স্থায়ী বাসা বাঁধে ‘এক কানু পড়েছে ধরা, হাজার কানু দিয়েছে সাড়া’। ওপাশে সুভাষপল্লির সরু গলি রাস্তাটা কোথায় যেন চলে গেছে। আমি চঞ্চল হে, আমি সূদূরের পিয়াসী। লোলুপ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকা, সে কোন রহস্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে, ডাকতেই থাকে, এই মধ্যবয়সেও। সুভাষপল্লির গলি পাবার আগে, রাস্তার একেবারে পাশেই কুণ্ডুবাড়ির একটা ঘর। সেটাও কেন যে চিরকাল বন্ধই থাকে, আর বন্ধ বলেই কী এক রহস্যে ঘিরে থাকে চিরটাকাল। ওখানেও বন্ধ ঘরের টিন বা কাঠের দেওয়ালে সেই আলকাতরায় লেখা ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’। চিন শব্দটা তখন অপরিচিত নয়, কিন্তু ‘মাও’ মানে কী? অপার বিস্ময়। সকালের দিকে লংকাবরের দিক থেকে আসা মাছওয়ালা, সবজিওয়ালারা হাঁক দিয়ে চলে যেত। গাল চুপসে যাওয়া একজন আসত গরম ‘পোয়ারুটি’ (পাউরুটি) নিয়ে। একজন আসত মুড়ির মোয়া নিয়ে। এই অ্যাত্ত বড় বড় মোয়া, আমাদের হাতের চেটোয় আটত না। দুই হাতে পাকড়ে সেই মোয়া দীর্ঘসময় ধরে আমাদের পেটের ভেতরে চালান করে দেবার রোমাঞ্চ এখনও অনুভবে ধরা দেয়। তো, সেই ফেরিওয়ালাদের কেউ কেউ আমাদের বাড়িতে এসে মাকে লক্ষ্য করে বলত, ‘নেন মাও, নেন। সব শ্যাষ হয়্যা গ্যাল’। আরেকজন এসে ডিম বিক্রি করত। তার আনা ডিমের আকার ছোট কেন? একথায় তার স্পষ্ট জবাব, ‘যায় পাচ্চে তাক কন। মুই কী জানং’। কথাটা মনে ধরেছিল খুব, সত্যি কথাই তো, ডিম পাড়ে হাঁস, মুরগি। তারাই বলতে পারে, কেন তাদের ডিম এত ছোট। তো, দেওয়ালে লেখা ‘মাও’ তাহলে বাংলার মা। বোঝা গেল। বালকবেলার সেই দেয়ালা জীবন জুড়ে, জীবনের দেওয়াল জুড়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে চেতনার আলোকরশ্মি তুমুল বিচ্ছুরণে অনন্তযাত্রায় সামিল হয়। কিন্তু বালকবেলার কোনও এক শীতরাতে লেপের ভেতরে সেঁধিয়ে থাকা শরীরে তীব্র কম্পন উঠেছিল। প্যাঁচার ক্রমাগত কোঁক কোঁক ধ্বনি, আর বহুদূরে শ্মশানযাত্রীদের ‘বলো হরি, হরিবোল’ সব মিলেমিশে একাকার। আজ স্কুলে যাবার পথে কুণ্ডুদের বন্ধ ঘরের সামনে কাউকে শুয়ে থাকতে দেখা, ফেরার পথে সেখানে ছোট্ট ভিড়। লোকটা মরে গেছে, সবাই বলছিল। তাহলে ‘মাও’ তাকে খেতে দেয়নি! আহা রে! আর, দ্যাখো, মাঝরাতে শ্মশানের পথে চিৎকার, ঘরের পাশে আমগাছে প্যাঁচার গোপন ষড়যন্ত্র, মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে হাজির! কেন মানুষ মরে! অনেকে না খেয়ে মরে। কেন খায় না? বোকার মতো মরে যেতে আছে!
বাবুরহাট চকচকার মাঠে সেই ভোরে তিনজনের রক্তাক্ত লাশ। সবাই বলাবলি করছিল, বছর পঁচিশের যুবক। তারা নাকি রাতের আঁধারে দেওয়ালে কিছু লিখছিল। পুলিশের একটি ভ্যান নিঃশব্দে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা এমনই মগ্ন হয়ে দেওয়াল লিখছিল যে ভারী বুটের আওয়াজ কানে যায়নি। তারপর এনকাউন্টার। খুব ভালো লেগেছিল এনকাউন্টার শব্দটা। তার মাহাত্ম্য বুঝতে একজীবন কী আদৌ যথেষ্ট! বালকবেলার দেয়ালা কতদিন অতীত হয়ে গেছে, এখন মহাশূন্যতায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে দেওয়াল লিখন। একটু একটু করে ধুসর হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দেওয়াল লিখন। হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব, বালকবেলা, কৈশোরকাল। শুধু কী তাই, এই মাঝবেলায় বুক ভরে শ্বাস নেবার চেষ্টায় ধড়ফড় করে বুক। তারুণ্য বিলীন উষর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে খুঁজি ভোরের শিশির।
সেই সব দিন আর ফিরবে না, ফেরেনি, ফেরে না! শৈশবের সেই সব মায়াজড়ানো সকাল, সেই সব ঘুঘু ডাকা নির্জন দুপুর, সন্ধ্যার মুখে বাড়ির পেছনের দিকে জঙ্গলে ডাহুকের ডেকে ওঠা, সন্ধ্যা একটু গভীর হলে কুকুরের তীব্র চিৎকার। কুকুরের সেই আর্ত চিৎকারে সকলের মন খারাপ হতো। সকলে বলত কুকুরের কান্না। কুকুর কাঁদলে সর্বনাশ হয়। দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ে। সেইসব দিনে প্রতি রাতেই হরিধ্বনি ভেসে আসত। প্রতিরাতেই বহুবার মানুষের সেই ভয়ানক চিৎকার বহুদূর থেকে ভেসে আসত। সেই হরিধ্বনি যে মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছে দিত, সেটা আমরা জানতাম। আমরা স্কুলে যাবার পথেও অনেক মৃতদেহ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি। আমাদের স্কুলেই একজন মরে পড়েছিল। তার নাম কাশী। সে নারী না পুরুষ তাও মনে নেই আজ। মনে আছে, বছরের দু-একদিন আমাদের ক্লাস হতো না। কারণ, শুনেছি, সেই কাশী স্কুলের কোনো ঘরে পায়খানা করে রেখেছে। স্কুলের বেড়া অনেক জায়গাতেই খসে পড়া থাকত। তীব্র শীতের রাতে সেই ফাঁক গলেই কুকুর বেড়াল ঢুকে পড়ত। ঢুকত কাশীও। কারণ, সে পথমানুষ। তার মাথার ওপরে ছাদ নেই, শোবার মতো চার দেওয়ালে ঘেরা একটা জায়গা নেই। অথচ, সে নাকি মানুষ! আমরা বিস্মিত হতাম। শুধু একদিন তাকে দেখেছিলাম পেছন থেকে। বিশাল বপু একজন, ছেঁড়াখোড়া লাল কম্বলে মাথা থেকে পা অবধি ঢাকা। ভূতের মতো মনে হচ্ছিল। স্কুলের মাঠের একদিকে বিশাল বটগাছটার পাশ দিয়ে সে যেন কোথায় চলে যাচ্ছে। সেই একদিনই, তারপর আর দেখিনি তাকে। তার কদিন পর শুনেছি, সে স্টেশনের কাছে মরে পড়ে আছে। মৃত্যু কত সহজ, সাধারণ ব্যাপার তখন মনে হয়েছে। আর, কাশী বা কাশীর মতো যারা তারা কি মানুষ? চিরকাল এই প্রশ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। আজও চোখের সামনে ভাসে ছেঁড়াখোড়া লাল কম্বলে জড়ানো একটা চলমান কিছু বটগাছের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে। মনে আছে, স্কুলের ঘরে ভয়ানক দুর্গন্ধ। এরকম হলে স্কুল ছুটি হয়ে যেত। আমরা খুশিই হতাম। স্কুলে আসতে এবং ঘরে ফিরতে আমাদের যতটা ভালো লাগত তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগত ক্লাস করতে। ক্লাস ব্যাপারটা মোটেই আনন্দদায়ক ছিল না। বইয়ের কালো কালো অক্ষর ছিল অপছন্দের। আমাদের বইয়ে কোনো ছবি ছিল না, কোনো রং ছিল না। আর, শিক্ষকদের অনেকের অসহনীয় নির্যাতন, অপমান। স্কুল ছুটি মানেই আমাদের বাঁধনহারা আনন্দ।
সেই দিনগুলোতে আমরা রোজ মৃত্যু দেখেছি। আর, শুনেছি প্রতিরাতেই বহুবার শ্মশানের পথে সম্মিলিত মানুষের প্রবল হরিধ্বনি। দেখেছি, পাড়ার ক্লাবের মাঠে হতভাগ্য মানুষের সপরিবারে বসবাস। মাথার ওপরে ত্রিপলের ছাদ। কাঠকুটো জ্বেলে তারা রান্না করত। কী রান্না করত তারা? মাটির হাড়িতে ভাত ফুটতে দেখেছি অনেকদিন। হাড়ির কানা উপচে গড়িয়ে পড়ত ভাতের ফ্যান। মায়ের কোলে হাড় জিরজিরে আদুল গায়ের শিশু। নানা বয়সী সেই শিশুরা শুধুই কাঁদত। এইসব শিশুদের কাউকে কোনোদিন হাসতে দেখিনি, খেলতে দেখিনি, কারও সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। তারা শুধু চেয়ে থাকত ফুটন্ত হাড়ির দিকে। এই সব পরিবার পরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, কেউ জানে না। কেউ জানলেও বলে না, বলেনি কখনও। তখন পাড়ার অনেকের মুখেই শুনেছি কে কতটা মড়া পুড়িয়েছে। একদিন বিকেলের দিকে, পাড়ার ক্লাবের মাঠে আমরা কয়েকজন ছুটোছুটি করছিলাম। যুবা বয়সীরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। একজন দাবি করেছিল, আর সাতটা মড়া পোড়ালেই তার একশো হবে। আরেকজন বলেছিল, আমার নিরানব্বই। তখনই স্টেশনের দিক থেকে এসে একদল শ্মশানযাত্রী বাঁদিকে মদনমোহন কলোনির রাস্তায় বাঁক নিয়েছিল। গন্তব্য যে শ্মশান সেকথা কাউকে বলে দিতে হবে না। তখন মুহুর্মূহূ চিৎকার করছিল শ্মশানযাত্রীরা। হরিধ্বনি দিতে দিতে কেউ কেউ হাসছিল। একদম পেছনে একজন একটু আস্তে হাঁটছিল বলেই বোধহয় পিছিয়ে পড়েছে। সে প্রবল চিৎকারে বলে উঠল, ‘বোলো হরি’। বাকিরা জবাব দিল, ‘হরি বোল’।