তোর্সার ঘরবাড়ি-১/মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
তোর্সার ঘরবাড়ি
পর্ব : ১
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
-----------------------------
এপার ছন ওপার বেড়া মধ্যে উঁচু বাঁধ
ওচারীর নাতি ঘনারাম চরের ধারে একখানা কাঠি পোঁতে। বর্ষাকাল। জল যত বাড়ছে বৃষ্টি ততই আপন মনে পাগল হয়ে উঠছে। যাপন কথার মাঝ বরাবর ওচারী, তিত্তিরী, ঘনু ঘনারাম, ঘঞ্চু, মনো, সুমিত্রা ওরা সব সকাল হতেই শহরের রাস্তায় বাবুদের বাড়ি যায়।মানকচু কাটে, মাথায় দেয় আর দৌড় লাগায়। ওচারী মাঝবয়সী। ছোট্ট বেঁটে একটুখানি। গুটি গুটি পায়ে হাঁটে। ওর খুলে আসা হাওয়াই স্যান্ডেলের স্ট্রাপে সেপ্টিপিন লাগানো থাকে। তরতরিয়ে নামে তাও বাঁধের উপর থেকে নীচে রাস্তায়। পায়ের ফাঁকে ফাঁকে ভিজে ওঠা হাজা দগদগ করে। সাদাটে কড়া পরা হাতের চামড়া শুকিয়ে উঠেছে এতক্ষণে। ঐ দত্তবাড়িতে কাজ সেরে সকাল শুরু হয় প্রতিদিন। টিনের দরজার ক্যাঁচ শব্দে সকালের ঘুম ভাঙে দত্ত গিন্নীর। এক্কেবারে বাঁধের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ওদের পাকা দালানের বাড়িটা অর্ধেকটাই দেখলে মনে হয় বাঁধের নীচে। সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা শরীর ঐ ছোট্ট পাহাড় পাহাড় দেখতে উঁচু বাঁধের।ঘঞ্চু, মোনা, মিলি, ঘনা ওরা যখন দৌড়ে রাস্তা থেকে উঁচু বাঁধটায় ওঠে ওদের মনে হয় পাহাড়ের গায়ের চড়াই উৎরাই খাঁজে-খোঁজে পা রেখে যেন এভারেষ্ট জয় করতে যাচ্ছে। ঐ পাহাড় পাহাড় ফিল নিয়েই ওরা ছোটে দিনের পর দিন। এতকাল সেই ছোট্ট থেকে বড় হওয়ার পথে দেখা হয় নিত্যদিনের রকমারি ভাল মন্দের কাজ কাজের বাড়ি আর চরের বাড়িতে। ঐ মিলন মাটি। মাটির শক্ত জমির বাঁধ।
ওচারীর ধুয়ে রাখা বাসন সোনার মতো ঝকঝক করে দত্তদের পাকা বারান্দায়। সকালের উঠোন ঝাঁটের শব্দে তরবড়িয়ে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে বাড়ীর খুদেরা।শেওলা এখন নেই।ফটফটে সাদাটে উঠোনের এক কোণে টিনের দোচালা রান্নাঘর, মাটির মেঝে।গতকালও ছিল বৃষ্টি ভেজা। আজ সকালটা অন্য মতো। লাগোয়া ঠাকুর ঘরের সামনেটায় উঠোনে একদিকে কোণে বড় বড় বেলগাছ পাতা ঝরিয়ে রাখে। রোদে পা পড়লে মর মর শব্দ ওঠে। অন্যদিকে কুঁয়োর পাড়ে চারঘরের চারটে ছোট লোহার বালতি দড়ি বাঁধা। হাতে হাতে মসৃণ। সকাল থেকে এ ঘর ও ঘর সে ঘরের কাজের লোকেদের হুড়মুড়ে তাড়া।কাজের ধরণও আলাদা। বড় বালতি ভরে নেয় যে যার দড়ি লাগানো বালতি করে।কুয়োর স্বচ্ছ জলে বড় বড় বালতি টইটম্বুর,সকালের অল্প রোদ ঝিলমিল করে।উঠোন থেকে পূর্বদিকের পারে দু খানা নারকেল গাছ পাশাপাশি দুজনে দুজনের মনের কথা বলে। উঠোনের ধারপাশ জুড়ে বাঁশের মাচানে কোথাও লাউপাতা দোলে সাদাটে ফুল আর কুঁড়ি সমেত। অন্যত্র বাঁশের মুলী চেগারে উচ্ছেলতা দোলে হলদে রঙের ফুল নিয়ে। কদিন পরই কচি উচ্ছেয় ভরে যাবে লতানে গাছ আর মুলী চেগার।এমনি বাঁশের মাচান দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে এঘরে ওঘরে যেমন, পাশাপাশি বাড়িগুলোতেও।
ছোট তরফের বউ কোন ভোরে উঠেছে, উঠোনের নিজেদের ঘরের কাছের জমি খুরপি দিয়ে নরম মাটি আরো নরম করে। হাতে ছিটিয়ে জল দেয়। আর ওচারী,সরলা,তিত্তিরীদের পথ চেয়ে অপেক্ষা করে। রান্নাঘর, উঠোন না আঁচালে দিন শুরু হবেনা। উনুন ধরানো যাবে না। অনেক সময় ওদের দেরী হলে নিজেই উনুন টেনে নেয়।খড়ির উনুন বাঘরের ভিতর পুরোনো আমলের সেই আখা সে তো সন্ধের বা রাতের ডাল ভাতের ঝোল তরকারি মেখে এঁটো হয়ে আছে। একটু দেরীই করে মঞ্জু। মন দেয় বাগানের কাজে।এবার লাল শাকের বীজ ছড়াবে রোদের ওমে।ধনে,পালং সব। রোদ উঠুক আগে।বাঁশের মাচানে ওর লক লক করছে পুঁই পাতা,কচি রঙীন ডগা আর কুমড়োর লতার হলদে কমলার মাইক ফুল।বিন্দু বিন্দু সকালের জল ফোঁটা ফোঁটা শরীরে।আহা! আর কটা হলে পেড়ে নেবে।বড়া করবে। শাশুড়ী ঠাকরুনের নিরামিষ পাতে এ বড়া মধুর মনে হবে।
....ওরে ঘনু...ঘনারে...এ গলাটা ওচারীর না?বিন্তিদের ঘরে কাজ অর্ধেক করে আবার বেরোলো নাকি!ঐ এক সবুজ ছোট বাঁধ মাথা উঁচু,বড় দীর্ঘ।এ পাড়া থেকে সেই পাটাকুড়া ছেড়ে দেবীবাড়ি পেরিয়ে কি সুঙসুঙি বাজারের দিকে যায়! মিত্রদের বাড়ির কাছে পুল পেরিয়ে মাথা উঁচিয়ে আছে।ওখান থেকে ঐ মানুষদের যাতায়াত এ বাড়ী,ও বাড়ী।অন্য বাড়ীতে কে গেল, কে ঢুকল দেখার সময় কোথায়! এক এ বাড়িতেই তো ঐ চরের বাসিন্দা চারজনেরই আসা যাওয়া। কখনো ওচারী তিত্তিরীর মুখ বদলে গিয়ে সুমি কিংবা নিরো। তবে সরলার মুখ বদল হয় না এ বাড়ির সেজ তরফের ঘরে। বেশ পরিপাটি রকমের সাজিয়ে কাজ করে দীর্ঘদিন ধরে।কোনো গল্প গুজব খুনশুটি পরচর্চা পরনিন্দায় সে নেই। সোনার মত ঝকঝকে কাসার বাসন বারান্দায় উপুড় করে। বেলা একটু বাড়তেই,সেও সকাল দশটার মধ্যেই রাস্তার কলের টাইমের জল আনতে কাঁখে মাটির কলসটা নিয়ে ও বেরিয়ে পড়ে।ওর হাঁটার যে দ্রুত ছন্দ ওটাকে কথ্থকের তিন তালের টানা ষোল মাত্রা মনে হয় এ বাড়ির ছোট্ট ছেলেটার।ওর মাতো ধরে বেঁধে তবলা শেখাতে দিয়েছে গুরুর কাছে। নতুন নতুন তাল শিখছে আর প্রকৃতির সব ছন্দের সঙ্গে ঐর ছন্দ মিলতে শুরু করেছে।সেই সকালের টুপটাপ শিশির অথবা সকালের ঝাঁটের শব্দ অথবা টুকটুক ঘন্টি বাঁধা গরুটার হেঁটে যাওয়া অথবা ওচারী মাসির ধপ ধপ কাপড় কাচার শব্দ। কেমন অদ্ভুত আয়োজনে প্রতিদিনের নতুন নতুন তালে চোখ খোলে আর বড় হয়।
এক ই নিয়মে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ এবার ডিসেম্বরের অ্যানুয়াল পরীক্ষার প্রতীক্ষা কিছুদিন জিরিয়ে রেজাল্ট। পরীক্ষা শেষের আর ঐ রেজাল্টের আগে পর্যন্ত সময়ের দিনগুলো মাঝবরাবর এবাড়ীর মানুষদের মনে উৎসব জেগে ওঠে। হঠাৎ হুজুগ ওঠে এ বাড়ির উঠোন ওবাড়ির বারান্দা থেকে কুমীর ডাঙা খেলতে খেলতেই.... এ্যাই,আজ রান্না হবে... এ এ,সত্যিকারের রান্না।ছোট ছোট মাটির উনুন মুহূর্তে এঁটেল মাটিতে তৈরি করে নিতে কতক্ষণ! বড়দের রান্নাঘরের মত সে উনুন দেখতে,কাজও হবে তিন ঝিকে,আগুনও জ্বলবে। আহা! কি আনন্দ,পিকনিক পিকনিক মৌজ।সবার ঘর আর অন্যবাড়ীর বাচ্চাগুলোও বিকেলের মধ্যে জুটিয়ে ফেলেছে চাল, ডাল, শিশিতে তেল, এবার এ বাড়ির ছেলেমেয়েরাই সংখ্যায় বেশি আর কাছাকাছি বলে সবার রান্নাঘর থেকে চক্ষুদান করে আনা পেঁয়াজ, লঙ্কার ভিড়ে খিচুড়িটা জমে ভাল। এ বাড়ির পুচকে মিনি আর ওর কাকুর ছেলে পুনু দুজনের উৎসাহ সবার চেয়ে বেশি। বিকেলের ধরাবাঁধা খেলা ওদের ঐ নদীটার বাঁধ বরাবর। সুতরাং চরের অমু, ঘনা, মিলু, রতু সবাই জোটে এসে। এসব আবার পছন্দ করে না এবাড়ির বিধবা জেঠিমা।--- ঐ অগো লগে না মিশ খাইলে তোদের চলেনা না? চুরি করবনে সব,পেন খেলাবাটি,তহন কাঁইন্দতে ব ইসনে... কে শোনে কার কথা,আজ বকুনী কাল ছাড়,আবার সকাল না হতেই গলাগলি।
আহা! চক্ষু জুড়োয় কাজ শেষ করে রোদে বসে থাকা চর বাসিন্দা কমল,ওচারী বিন্দিদের।ফিস ফিস আলোচনাও চলে।...দেখচস,ঐ মিত্তিরদের ছাওয়াল পাওয়াল গুলানরে, হেই ঘনা, অমু, মিনুর লগে না খেইল্ লে অগো ভাত হজম হয়না রে....মুখগুলোয় আলো পড়ে। ভদ্র বাড়ির আলো। রোদ লেগে উজ্জ্বল হয় কারো কারো একঢাল খোলা চুল, আবার তো রোদ নিভে আসার আগেই দ্বিতীয়বার কাজের বাড়ি গুলায় পর পর যাওয়া।কারো বাড়ীতে উঠোনের কাপড় ভাঁজ করে তুলে রাখে নিজেরাই। বলতে হয় না। কাজের হিসেব করে না ওরা। টাইমকলের জল এবেলা ওবেলা দু বেলাই মজুত দেয় ঘরে ঘরে। রাতের রান্নার মশলা করে দেয় বাটিতে বাটিতে। একবেলার মশলা একবেলাতেই শেষ হয়,আবার সকালে হলুদ বাটা,জিরে,আদা ধনের গন্ধে হাত ভরে, রান্না ঘরের উষ্ণ ওম্ পূর্ণ হয়।জল আসে জিভে।ওদের যাপনেও কাজের বড় বাড়িগুলোর মতো উঠোনে বাঁশের মাচান,মুলী চেগার,উঠোনের ফটফটে সাদাটে আঁচল,কলস ভরা খাওয়ার জল, গুছিয়ে তোলা আনাজপাতি হলোই বা চেয়ে চিন্তে আনা, উঠোনের ডগডগে লতার ঝোল তরকারি, সঙ্গে খুব কাছ দিয়ে চলা নদী জলের সখ্য। ভেসে যাওয়া কচুরীপানা আর বেগুনী রঙের ফুল।কত কাঠ ভাসে ঐ নীলচে জলে।বাড়ী বসে থাকা পুরুষেরা বড় অলস।তবে কয়েকজনের পিটানো শরীরে কালচে রঙে রোদের ছায়া।বনে বনে ঘুরে দুরন্ত রোদের ছাপ। আর আগলে রাখার ইচ্ছেটাও বড় বেশি। নমিতা যখন চরের বাঁশের দরজা হালকা হাতে বন্ধ করে ভোর ভোর কাজের বাড়ী বের হয়,প্রতিদিন ওর চাদরের নীচে শুয়ে থাকা সোয়ামির আদর উথলে ওঠে,আহা, আমি তোরে কাজে যাবার দিতামনারে,যদি না...ঐ যদি নার পরে যে কিচ্ছু বলার নেই নমিতার মতো চরের মেয়েরা ভালই জানে। তবু বিয়ে করে।বাবা মা আয়োজন করে অল্প, ওদের তাহ দাও অল্প,দেহ আছে,যৌনতা আছে, পোয়াতি হয়ে উঠবে ঐ মেঘের মত ওরা জানে সেটা। বন্য জঙ্গুলের মতই ওরা রাতের অন্ধকারে ভালও বাসে আর এই অকর্মন্য অভ্যেসে সোয়ামীগুলাকে আদরও করে। কাজের বাড়িতে বেরিয়েও যায় জানে মাস শেষে সব টাকা নিজের কাছে রাখার সাধ্য সকলের নেই। ঘরে পুরুষগুলা শুধুতো অকর্মন্য অলস তাই না,মদ বাহারে মন।বাংলা ধেনো না হলে অনেকেরই চলে না। রাতের বেলা লেগে থাকে চিৎকার। সবকিছুর যোগানদার ঐ এক মেশিন বউ। ওদের মধ্যে ঐ ওচারী,তিত্তিরী, কমলা, সরলা,হেমন্তী, নমিতাদের ভিড়।নমিতার বরের মাঝে মাঝে বিবেক জাগে।তোর্সার জল ওকে টানে। ভেসে পড়ে এদিক ওদিক,কাঠের লগ যোগাড় করে। গোপনে বিক্রিও করে এদিক ওদিক। একটু আধটু পয়সা জমে হাতের নাগালে। নমিতার জন্য বড় মন কেমন করে যে,ওর আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে হাজা হলে মলম কিনে লাগায়। নমিতা সন্দেহের চোখে তাকায়'পয়সা পাইল্যা কই থিক্যা বল?বর অনলের কেমন পোরুষ জাগে,ভালবাসতে ইচ্ছা করে।নমিতা ঝটকা টানে সরায়।...'আর যদি দেখছি তুই সাঁতার দিয়া ঐ পারে সেই মুলুগ গেছিস,ভাল্ হবেনা কিন্তুক।'...'ক্যান ম ইর্ ব না দেখিস।ঐ চর ছাইড়্যা একদিন দেখিস ঘর বানাব ঐ মাঝ বরাবর বড় কাজের বাড়িগুলার পাড়ায়...দেখিস?...ও ও ভারী ইচ্ছা তর্, সে দেখা যাবে খন। অহন ছাড় দেহি। নদীত্ ডুব দিয়া আসি অনে। অনল সরে। মাটির ছোট উনানটা গুল কয়লায় সাজায়। হৈ হৈ করে নমিতা,...ওরে,আইজ্ খড়ি দিয়া রাইধ বতো।তুই ওই গুলা খরচা করিসনা। 'আইচ্ছা,আইচ্ছা।ঠিক ঠিক। তুই খড়ি দিয়াই রাধস আজ।আমি এইডা সাজায় রাখি।নমিতা পুরোনো হয়ে যাওয়া হালকা রঙ ওঠা লালচে গামছাটা টেনে নেয়। সোজা ছোটে নদীর দিকে। এ ওর নিজস্ব সময়। কাজের বাবুদের বাড়ী যাওয়ার সময় পরিপাটি আবার কাজ থেকে ফিরে এই স্নান সৌখিনতাটুকু এদের সকলের। এই চর বসতির মেয়ে বৌ বহুক্ষণ আলাপ ভাঁজে নদীর জলে।কান পেতে শোনে অকুল বয়ে যাওয়ার শব্দ। ওরা ডুব সাঁতার চিত সাঁতারে ওস্তাদ একেবারে। কি গ্রীষ্ম কি শীত ওরা ঐ স্নানের পর চরের ছোট ছনের বাড়িগুলো ছেড়ে রোদ পোহাতে আসে চওড়া বাঁধের ওপর।কখনো বাঁধ জুড়ে বড় বড় বোলডারে বসে গুলতানি করে।বিকেল হওয়ার আগের সময়টা শুধু ওদের।ঐ উপরে বসে নীচের রাস্তার কত বাড়ির চিত্র আর চরিত্র যে ওরা দেখে আর মনে মনে নকসা বানায়।কল্পনায় গল্প জোড়ে।...বুঝলি তিত্তিরী,ঐযে ঘোষ বাড়ির ডাগর মাইয়াটা ওইটার লগে ঐ কুয়ার পাড়ে আড্ডা দেয় দেখছস না, ঐ গুহ বাড়ীর ছেমড়াটা,কি য্যান নাম...মলয়...মলয়দা ঐ দুইডার লগে ইষ্টু বিষ্টু কিছু এট্টা চলত্যাছে।...ঝাঁঝিয়ে ওঠে সরলা- কি কস? জানস নাকি সব? না জাইন্যা এগলা কইবিনা বুঝলি।পাচজনের কাছে ছড়াবিনা।ঘোষ বাড়ীর ঐ মেয়ে কলেজে পাশের পড়া পড়তেছে।শুনছি পড়াতেও ভাল।ও ক্যান মলয়ের লগে আনসান চিকনাই করবে!ওর মা যা কড়া ধাত দেখসনে।
মুখ বাঁকায় মনো। যত রাজ্যের বানিয়ে তোলা কথার স্বর্গ আর নরক নিয়েই বাঁচে ওরা।গল্প নিজেরাই বানায় নিজেরাই ভাঙে। রোদ নামলেই পড়িমরি ছোটে নীচে রাস্তার দিকে। ...টাইম কলের জল আইস্যা পড়ছে।চল্ চল্...সরলাই দৌড়য় আগে।ওচারীর বয়স হয়েছে।মুখ ভরা বসন্তের দাগ।কালো রঙের ছোট্ট চেহারা ওচারীকে ঐ তল্লাটে সবাই মানে।ওর কানের লতিতে কোন সময় দুল ছিল, বেঁধানো লতিতে দুটো ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়, লতি ঝুলে পড়েছে। দু হাতের শাঁখাও পুরোনো দাগ ধরা। পলা নেই। বড় মিত্র বাড়ীর খুদে কন্যা মিনি আর ছেলেটা পুনু দুজনে ঘুর ঘুর করে ওচারীর পিছু পিছু।ওর মশলা বাঁটার গন্ধ শোঁকে পাশে বসে থাকে।ওর জল আনতে যাওয়া বা বেঁকে বেঁকে কষ্ট করে জল বয়ে নিয়ে আসার পথে দুজন সঙ্গ নেয়। ওচারীর মাথা ছুঁতে পারে ওরা দূজনে। পিছন পিছন হাঁটে,খুনশুটি চলে।এতটুকু রাগেনা ওচারী। কাজ সেরে সন্ধের প্রদীপ তুলসী তলায় সাজাবে যে।ধূপের গন্ধ ও ওদের উঠোন জুড়ে। পাশে মিটমিটিয়ে হাসে তোর্সা আর তুচ্ছতার হাসি নিয়ে বয়ে যায় বয়েই চলে।
বৃষ্টিতে উঠোনে নামা বারণ। মাটি নরম হয়ে আছে।সবাই যে যার মতো ছাতা হাতে বাইরের খোলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। আর এ বাড়ীর দুই ভাইয়ের দুই খুদে পুনু আর মিনিকে আগলে রেখেছে ঠাকুমা স্মরণবালা আর জেঠিমা সুধা।প্রাণ আঁকুপাকু। খেলাও বন্ধ কদিনের লেগে থাকা ধুম বৃষ্টিতে।দুদিন যে তিত্তিরী বা ওচারীরা কিভাবে কাটিয়েছে সে কথাই চরবাসী ওচারী আর সরলা ভয়ার্ত মুখে বলে যাচ্ছে। বাড়ির বড়রা নানা পরামর্শ দিচ্ছে ওদের।রাতের বেলা জল বাড়লে যেন ওরা সদল বলে পুনুদের বারান্দায় চলে আসে, এমনও বলছে জেঠুমণি, বাবা। পুনুর বুকের মধ্যে কেমন আনন্দ গুর গুর করে,আরে তাহলে তো ঘনাদা,অমু,রতু...সবাই আসবে।অন্ধকারে আঁধার আঁধার খেলা ভূতুড়ে খেলার আস্তরণ মনে মনে সাজিয়ে নেয়।মা ভাজবে গরম গরম রুটি, রেখে দেওয়া ঝোলা গুড় দিয়ে মনে হবে অমৃত। পুনু আর মিনি চোখে চোখে কথা বলে।হেসে নেয় অর্থপূর্ন হাসি। ওচারী ততক্ষণ বলে যায়...'জানেন গ বৌদি, ঘনাটা লম্বা এক কাঠিবাঁধের কোণে কাদায় গুঁইজা দিয়া এবেলা ওবেলা জল মাপতেছে। সে রাত ভোর হইতে দেহি সে কাঠি কোথায় ভাসায় নিছে।সব বোল্ডার,ছুট পাথর সবকিছুর মাথার উপর দিয়া জল উইঠা বইছে।নমিতার সোয়ামি অনল এক কাঠের নৌকা বানাইছে। ওইটা নিয়া হ সে ভাইস্যা বেড়ায়, চুনাপুটি তোলে অল্প জলে।এই তো কাম।...কোথায় যাবনে কাইল, তার ঠিক নাই। জল নামবে কিনা দেওতা জানে....
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴