তিস্তাবাথান : পর্ব-১
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
""""""""""""""""""""""""""""""
কয়েকজন তিস্তাপুত্রের নাম উল্লেখ করেই ‘সহজ উঠোন’এ বাথানের ছবি লেখা শুরু করলাম। খোলাভাজা, পাকামাথা, বায়া নূড়ল, কাইচালু, বাউরা। বেঁচে নেই আজ তাঁরা। বছরের পর বছর ধরে যাঁরা মধ্যতিস্তার চরে চরে আজও বাথান সামলে চলেছেন তারা হলেন বাচ্চু, ল্যাপা, লাল, ভগলু, তালেব, আমির, পূরণ, সানিয়া।
সানিয়া মূর্মু। ভালোবেসে তাকে আমি তিস্তার জেষ্ঠপুত্র বলি। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে তিস্তা মা তাঁকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছেন। তিস্তাবুড়ির মায়ায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা পরেছেন তিনি। ভাটিদেশের বগুড়ার চর, কালামপুরের চর থেকে উজানের বুড়ির টুম অথবা চুমুকডাঙ্গী। কত চরই না তিস্তায় জেগেছে বা ডুবেছে। তিস্তাবক্ষের মাঝে এমন কোন চর নেই যেখানে তিনি শ’য়ে শ’য়ে মহিষ নিয়ে বিচরণ করেননি। যে ক’জন তিস্তাপুত্রের নাম আগে নিয়েছি তাঁরা প্রত্যেকেই মহিষ-রক্ষক, মহিষের রাখাল। যাঁদের আমরা মৈষালবন্ধু বলি।
মাহুত বন্ধু, গাড়িয়াল বন্ধু, মৈষাল বন্ধু। উত্তরের এই তিন বন্ধুর কথা কেইবা না জানে। গাড়িয়াল বন্ধুর গরুর গাড়ি নেই। মাহুত বন্ধুর হাতি নেই। মৈষাল বন্ধুর বাথান নেই। আধুনিক সভ্যতা ও ভোগবাদী মানসিকতার জাঁতাকলে হারিয়ে যাচ্ছে সব। আশার কথা এই যে বর্তমান গজলডোবা থেকে জয়ী সেতু পর্যন্ত সুদীর্ঘ তিস্তা অববাহিকার মাঝে পাঁচটি মহিষের বাথান আজও টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুঃখের কথা এইযে হয়তো এই বাথানগুলি দাঁতে দাঁত চেপে আর মাত্র বছর পাঁচেক টিকে থাকতে পারবে। তার পরই তিস্তাবক্ষ থেকে চিরদিনের মত বিলুপ্ত হবে কয়েকশো বছরের পুরনো বাথান সংস্কৃতি। সাথে সাথে হারিয়ে যাবেন এখণও পর্যন্ত টিকে থাকা দশ বারো জন মৈষাল বন্ধু।
বাথান কথার শব্দ বিন্যাস কোন উপন্যাস সৃষ্টি করবে না এখানে। কোন রকম কল্পনা স্থান পাবে না এই নিবন্ধে। বাথানের অতীত আর বর্তমানকে তুলে ধরতে হয়তো বর্তমান তিস্তাপুত্রেরা ঘুরে ফিরে আসবে বারেবারেই। কারণ তাদের কথাই বলুন আর ব্যাথাই বলুন যদি আজ তুলে না ধরি তবে এই ক্ষুদ্রপ্রয়াস তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।
লেখার শুরুতেই বড় সমস্যায় পরে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম কতবছর আগের এই বাথান কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো । আসলে এই বাথান সংস্কৃতি ঠিক কত পুরনো তার সঠিক তথ্য কোথাও এই লেখক পাননি। প্রাচীন কামরূপনগর বা গিরি থেকে মৈষাল বন্ধুরা যে মহিষের পাল নিয়ে তিস্তার ভাটি থেকে উজানে আসতেন এর উল্লেখ বহু বইয়ের পাতায় পাওয়া যায়। কিন্তু তার কোন প্রমাণ মেলেনা। যাইহোক, সমস্যার সমাধান সূত্র খুঁজে বের করতে পেরেছি অবশেষে।
তিস্তাবক্ষের সবথেকে বেশী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মৈষাল সানিয়া মূর্মু। সানিয়া মূর্মু বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তিস্তার মাঝে রয়েছেন। আজও বাথান সামলে চলেছেন। সানিয়া মূর্মু ও তার মতো কয়েকজন মৈষাল বন্ধুর কথা যেহেতু এই লেখার সম্পদ তাই এই বাথান কথা সত্তর থেকে আশি বছর আগের বলেই আপনাদের ভেবে নিতে হবে।
মৈষালবন্ধু শব্দটির সাথে আমরা যতটা পরিচিত বাথান শব্দটির সাথে বর্তমান প্রজন্ম তেমন ভাবে সুপরিচিত নয়। তাই প্রথমেই বাথান বস্তুটি আসলে কি সেদিকেই আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
মহিষের বাথান আসলে কী?
বাথান ও নদীর চর, একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। উত্তরের প্রাণের নদী সদানীর তিস্তাকে কে না জানে। তিস্তার বুকের ওপর অনেক চর রয়েছে। বহু চরের ভাঙা গড়ার খেলা, বহু চরের ডোবা-জাগার খেলা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। সত্তর-আশি বছর আগের সেই তিস্তাবক্ষ কিন্তু আজ আর নেই। কেমন ছিল সেদিনের তিস্তাবক্ষ? গল্পের চাকাটা সেদিকে না ঘুরিয়ে বরং মূল বিষয়ে ঢুকে পরা যাক।
মহিষ চরানোর প্রধান জায়গা হল নদীর চর। একটি দু’টি মহিষ নয়। সত্তর আশি বছর আগে এক একজন জোতদার বা জমিদারের একশ থেকে তিনশ’ মহিষ ছিল। আর নদীর চরে চরে যে রাখালেরা এই মহিষ চরিয়ে বেরাতেন তারাই হলেন আমাদের মৈষাল বন্ধু। মহিষ চরানোর কথা উঠলে হয়ত একটা ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সারাদিন মাঠেঘাটে বা নদীর চরে মহিষ চরিয়ে রাখালেরা ঘরে ফিরছেন সূর্যডোবার আগে। কিন্তু মহিষ চরানোর কথা আজ লিখছি তা কিন্তু একেবারেই আলাদা।
বর্ষাশেষে যখন নদীর জল কমে যায় তখন তিস্তায় অনেক নতুন নতুন চর জেগে ওঠে। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘টুম’ পরা। সাথে পুরনো চরতো থাকেই। এইসব নদীর চর বর্ষাশেষে ঢেকে যেত মধুয়া, কাশিয়া, নেউতি, নেউসী, ডুডুয়া, হোগলা, কোচলত, বাগাচূড়া, নলখাগড়া এরকম সব নাম জানা ও অজানা অনেক গাছ ও আগাছা দিয়ে। এছাড়া নদীর ধার বরাবর শাল, সেগুন, শিমুল, জারুল, চিকরাশির ঘন জঙ্গল ও কাঁটা ঝোপঝাড়তো ছিলই। ছিল মহিষের প্রিয় খাদ্য টোটুয়া ও ঝাপসী ঘাস। এই ঘাস জন্ম নিত দিলকিবারির ওপর। আসলে দিলকিবারি হল তিস্তাবক্ষের ওপর দহলা জমি। পায়ের এক ধাক্কায় বিঘার পর বিঘা দুলে উঠত সে সময়। জঙ্গলে পরিপূর্ণ এই পরিবেশের মধ্যে বাঘ, হাতি, বাইসন, শুঁকর, নেকড়ের ছিল অবাধ বিচরণ। তিস্তাবক্ষ হয়ে উঠত ভারী বিপদসংকুল। আর এই বিপদসংকুলতার মাঝেই জোতদার আর জমিদারেরা রাখাল বালকদের মহিষের পাল ধরিয়ে পাঠিয়ে দিতেন ভাটি থেকে উজানের দিকে। প্রাচীনকালে কামরূপ, গোয়ালপাড়া, গৌরীপুর, গিরি থেকে প্রচুর মৈষাল এসে অস্থায়ী ঘাঁটি গাড়তেন তিস্তাচরে। স্থানীয় জমিদার জোতদারদেরও প্রচুর মহিষ ছিল। তারাও রাখাল বালকদের বর্ষাশেষে তল্পিতল্পা ধরিয়ে পাঠিয়ে দিতেন তিস্তাচরে। মহিষের দেখভাল ও বাথান নির্মানের জন্য তখন তিস্তার পরিবেশ ছিল বেশ অনুকূল।
মহিষের রাখাল বা মৈষাল বন্ধুরা জীবনের তাগিদে কয়েকমাসের জন্য আসত এই রোমাঞ্চবাসে। তাঁদের প্রতি পদে পদেই লুকিয়ে থাকত বিপদ। তাই নিজেদের সুরক্ষার জন্য তাঁদেরকে জোট বাঁধতে হত। একা একা বাথান নিয়ে থাকবার সাহস তাঁরা দেখাতেন না । থাকতেন তিস্তার বিভিন্ন চরে দল বেঁধে। বাঁশ জোগাড় করে ‘ভাবনি’ কেটে নলখাগড়ার বেড়া বানিয়ে ঘর বাঁধতেন তাঁরা। আগে মহিষের মালিকেরা ছাউনির জন্য টিন দিলেও পরে আর তা দিতেন না। কারন তখন তিস্তায় ডাকাতের উপদ্রব ছিল। ডাকাতেরা সেই টিন বলপূর্বক খুলে নিয়ে চলে যেত। রান্নাঘর, শোবার ঘর, টংঘর ও মহিষ শাবকদের (পারু) থাকার জন্য ঘর তৈরী করত তাঁরা। বড় মহিষেরা সারারাত থাকত খোলা আকাশের নীচে। তাঁদের পায়ে বেঁধে দেওয়া হত ডোর বা বেড়। ঠেগা বেঁধে দেওয়ার চলও ছিল। ঘাসের লোভে বা জল খেতে মহিষেরা যাতে রাতের অন্ধকারে অন্যত্র চলে না যায় তাই এই ব্যবস্থা।
মহিষ চরাবার উদ্দেশ্যে রাখাল বালক বা মৈষাল বন্ধুরা ছোট ছোট দল বেঁধে থাকতেন চরের মাঝে। তিস্তাবক্ষে তাঁদের এই যে সঙ্ঘবদ্ধ বসবাস, একেই আমরা বলি বাথান। স্থানীয় ভাষায় একে ‘ধূরা’ও বলা হয়। বর্ষা শেষ থেকে বর্ষা শুরু পর্যন্ত সময়ে তিস্তার চরে-চরে সারিবদ্ধভাবে যে অস্থায়ী কুটিরগুলি তৈরী হত আজ কিন্তু তার দেখা মেলা ভার। আসলে তিস্তাবক্ষে সেদিনের সেই ঘন জঙ্গলও নেই। নেই বন্য পশুর ভয়ও। সত্তর আশি বছর আগেও তিস্তার বিভিন্ন চরের মাঝে তিনশ’ থেকে সারে তিনশ’ বাথান ছিল। আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় সব। টিকে রয়েছে মাত্র পাঁচটি। তবে সেদিনের বাথান আর আজকের বাথানের মাঝে রয়েছে আকাশ জমিন ফারাক।