সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
16-June,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 603

টুপটাপ উত্তর-১/শুক্লা রায়

টুপটাপ উত্তর-১/শুক্লা রায়

ধলতা

"আরে বাছাই কর বাছাই কর। এগুলোও বাছাই কর। সুভাষদার মাছ।" হাত বাড়িয়ে নির্দেশ দিতেই মোটা মোটা কালো আঙুলে পাথর বসানো সোনার আঙটিগুলো ঝকমকিয়ে ওঠে। মাছের ডাক হচ্ছে। জিতেন নিজে লেখাপড়া না জানলেও ছেলেদের স্কুলে পাঠিয়েছে। বড় ছেলেই খাতা লিখছে, জিতেন নিজে ডাকছে, "একশ চল্লিশ। একশ চল্লিশ।" কেউ একজন ডাক দিল "একশ পঞ্চাশ, পঁয়ষট্টি।" জিতেন সঙ্গে সঙ্গে রিপিট করল "একশ পঞ্চাশ, পঁয়ষট্টি; একশ পঞ্চাশ, পঁয়ষট্টি।" আর ডাক উঠল না। দু'কেজি ওজনের কাতলাগুলো একশ পঞ্চাশ টাকা পঁয়ষট্টি পয়সা অব্দি উঠেই থেমে গেল। চারদিকে মাছও যত ডাঁই করা, মানুষও তত মাছির মতো ভনভন করছে। ওর মধ্যেই জিতেন গেলাসে করে চা খায়। অনর্গল ডাক ওঠায়। মাঝে মাঝে এর তার সঙ্গে দু'একটা দরকারী কথাও সেরে নেয়। ওজন অনুযায়ী মাছ বাছাই করার জন্য দুটো লোক রেখেছে। ওরা এই সকালটায় তার সঙ্গে কাজ করবে, শেষে হাতে গরম হাজিরার টাকা পেয়ে গোটা দিনটা অন্য কাজে লাগাবে অথবা শুয়ে বসে কাটাবে, সে ওদের ব্যাপার। একজনের আবার একটু গঞ্জিকা সেবনের অভ্যাসও আছে। কাজ শেষ হলেই ও ছুটবে ওর নেশার পেছনে। তবে জিতেন বলে রেখেছে কাজের সময়ে ওসব নৈব নৈব চ। জিতেন কিন্তু বসে থাকে না। অত যে টাকা পয়সা করেছে, তবু এখনও ডাক শেষ হলে নিজে মাছ হাটিতে নিচে বসে মাছ বিক্রি করে, মাছ কাটে। ছোট ছোট গেরস্তের মাছ ডাকে তেমন দাম না উঠলে নিজে কিনে সেগুলো খুচরো বিক্রি করে। আর ধলতায় পাওনা মাছগুলো তো বেচেই। ধলতা হল কেউ মাছ নিলাম করাতে আনলে সেখান থেকে জিতেন আগে পছন্দসই একটা মাছ তুলে নিজের কাছে রেখে দেবে, তারপর বাকি মাছ বাছাই করে, ওজন করে 'ডাক' হবে। কাজ করতে জিতেনের আলিস্যি নেই। একটা সময় সেই ভোর থেকে মাছ ধরত। সকালে কলার পাতায় ঢেলে মাছ বেচত। আবার সারাদিন মাছ ধরে সন্ধ্যায় হাটের এক কোণে কলাপাতায় মাছ ঢেলে 'ভাগা' হিসেবে বেচত। সেসব দিন কি ভোলার! গেরস্ত বাড়ি থেকে ডাক এলে শীতকালেও অন্ধকার থাকতে থাকতে ঠান্ডা জলটায় তারা জাল টানত। ওরা দলে ছিল পাঁচজন। পাঁচটা মানুষ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জলে নামত। কেজি পিছু পাঁচটাকা ছিল হিসেব। তবে মাছ কম উঠলে অথবা শুধু জাল টানার জন্য ডাকলে ওরা মালিকের কাছে হাজার টাকা চেয়ে নিত। আর শুধু কী মাছ তুলতেই ডাক পড়ে? মাছের ওজন, সাইজ দেখার জন্যও জাল টানতে হয়। এতে মাছের বৃদ্ধিও হয় দ্রুত। মাছ জালে উঠলেও আবার জলেই ছেড়ে দেয়। ওরা পায় ওদের হাজিরার টাকা। এই শীতে জলে নেমে মোটে মাথাপিছু দুশো টাকা। এতে সংসার চলে? কারোরই চলে না। তবে নদীই ওদের বাঁচিয়েছে। ডানে জলঢাকা, বামে ডুডুয়া। এই নদীর মাছ বেচে বেচেই জিতেন আজকে নিজের বাড়ি করেছে। নিজের আড়ত করেছে। সেদিন আর এদিনে অনেক তফাত। তখন জিতেন মন চাইলেও জালে ওঠা বড় মাছটা নিজের জন্য রাখতে পারত না। সে মাছটা বেচেই তাকে সংসারটা সচল রাখতে হত। মাছ বিক্রির পয়সায় বাজার হলে তবে উনুনে হাঁড়ি চড়ত। আর এখন হাত বাড়ালেই যে কোনো সাইজের, যে কোনো দামের মাছটা মুঠোয় চলে আসে।
সেবার ছোট ছেলেটার বড্ড শরীর খারাপ। পুজোর ঠিক আগে আগে। বায়না করল বড় মাছ খাবে। সারাদিন নদী নদী ঘুরেও সেরকম বড় মাছ পেল না, এমনই কপাল! তবে ঈশ্বর সুযোগ করে দিলেন। মনোরঞ্জন বাবু খবর পাঠালেন, জাল টানতে হবে। ভগ্নীসহ ভগ্নিপতি এসেছে। পুকুর থেকে মাছ তুলতে হবে। জিতেন ছাড়া আর কাকে ডাকবে! এ ব্যাপারে জিতেনের হাত বরাবরই ভালো। কয়েকটা টান দিতেই বেশ বড় সাইজের কাৎলা উঠে এল। নদীতেই তেমন তেমন হলে জিতেনের হাতে সেরকম মাছ ধরা পড়ে আর এসব তো হল গিয়ে পোষা মাছ! ধরা দেবার জন্য গলাটা বাড়িয়েই আছে। পয়সা দিতে এলে এবার জিতেন অনুরোধ করল টাকার পরিবর্তে পুকুরের টাটকা একটা বড় মাছই দিতে। কিন্তু মনোরঞ্জন বাবু কী আর রাজী হন! যেখানে দুশোটা টাকা দিলেই ঝামেলা চুকে যায়! বদলে জিতেনকে কিছু কুচো মাছ আর মজুরীর দুশোটা টাকা দিয়েই বিদেয় করলেন। সে টাকা দিয়ে জিতেন বড় মাছই কিনল তবে মনে বড় আক্ষেপ থেকে গেল। নিজের হাতে তোলা পুকুরের টাটকা মাছ আর হাটের সস্তার চালানি মাছ! রাত-দিনের ফারাক! তবে সময় কি আর থেমে থাকে! জলঢাকার জল যত গড়াতে লাগল জিতেনের অবস্থাও দিনদিন কেন যেন তত ফিরতে লাগল। প্রথম যেদিন দুই বান ঢেউটিন কিনে খড়ের ছাউনি সরিয়ে একটা ভালো ঘর বানাতে পারল, সেই দিনটার কথা জিতেন ভুলতে পারে না। কী সুখ কী সুখ! এত টাকা হয়েও সেদিনের আনন্দটুকুই সেরা মনে হয় জিতেনের। বউয়ের শ্যামলা মুখটা খুশিতে একেবারে ঝলমল করছিল। সে কথা কী জিতেন হালদার ভুলতে পারে! যেমন ভোলেনি অসুস্থ ছেলের আব্দারেও মনোরঞ্জনবাবুর বড় মাছটা না দেবার কথা। অবশেষে কেটে অর্ধেকটা দিতেও হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিল জিতেন। কিন্তু বাবুদের মন কী আর সহজে গলবার!
এখন জিতেন চাইলেই সেরা মাছটা তুলে নিতে পারে যে কারো পুকুরের। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তা করে না। গিরি বুঝে মাছ তোলে। কারো কাছ থেকে নিয়ম রক্ষার মতো যে কোনো মাছ রেখে দেয় তো কারো ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দামী মাছটাই ছোঁ মেরে তুলে নেয়। সে মাছ মালিকের মুখটা যতই কালো হয়ে উঠুক। এখানে কারো আপত্তি ধোঁপে টিঁকবে না। একটা সময়ে মাছ নিয়ে সেই ভোর ভোর সময় থাকতেই ধূপগুড়ি নিয়ে যেতে হত নিলামের  জন্য। আর এখন এই ঝিনাইমারি গ্রামেই নিলাম করছে জিতেন। ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি -সব জায়গার পাইকার আসে মাছ কিনতে। এখানকার মাছের আবার খুব চাহিদা আশেপাশের হাটে-বাজারে।
চা খেতে খেতেই কখন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ সামনে তাকিয়েই দেখল বড় বড় দস্তার হাঁড়িতে করে মনোরঞ্জনবাবুর বাড়ির মাছ এল। জিতেন একনজর তাকিয়ে দেখল। তারপর আঙুলটা তুলে নির্দেশ দিতেই কালিচরণ সবচেয়ে বড় মাছটা তুলে সরিয়ে রাখল। কালিচরণ শুধু নয় উপস্থিত অনেকেরই মুখে একটা অস্পষ্ট হাসির রেখা দেখা গেলেও জিতেনের মুখের কোনো ভাবান্তর হল না। নির্বিকার গলায় এক ছন্দে ডাক দিতে লাগল, "একশ পঁয়ত্রিশ। একশ পঁয়ত্রিশ। একশ পঁয়ত্রিশ পঞ্চাশ। একশ পঁয়ত্রিশ পঞ্চাশ।"

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri