চা-ডুবুরি : পর্ব :১
সুকান্ত নাহা
-------------------
চা শ্রমিক: অতীত দিনের ধূসর খন্ডচিত্র
***********************************
ভোররাতে আলো ফোটার অপেক্ষায় ঘন অন্ধকার যখন থমকে থাকে খোড়ো চালার ফাঁকে, মাকলা বাঁশের ঝাড়ে, চা-গাছের নিবিড় ঝোপে, বাসকের বেড়ায়- ঝুপসি অশ্বত্থের ডালে রাতচরা পাখিরা যখন তাদের রাতের সফর সেরে কোটরে ফেরে, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘুম ভাঙে সুরিয়ার। ঘুম ভেঙেই স্তনবৃন্ত থেকে শিশুটিকে আলগা করার চেষ্টা করতেই সে কেঁদে ওঠে । আলতো চাপড়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে সুরিয়া যখন সন্তর্পণে মাটিতে বিছানো বাঁশের মাচাটা ছাড়ে আরেকটা হাড়ভাঙা দিনের চাবুক আছড়ে পড়ে সুরিয়ার পিঠে।
চাবুকের তাড়নায় অস্থির হয়ে সুরিয়া শলাই হাতড়ায়। চটজলদি ডিবড়ি (কুপি) খুঁজে আগুন ধরায়। ডিবড়ির আলোয় মাটির ঘৈলা (কলসি) সমেত নেঠো (বিড়া)টা মাথায় চাপিয়ে কোমরে দাঁতন কাঠিটা গুঁজে নেয়। এরপর একহাতে জ্বলন্ত কুপি অন্যহাতে এঁটো বাসনগুলো নিয়ে লড়ঝড়ে টিনের দরজা ঠেলে নিচু হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। উদ্বিগ্ন চোখে একবার পুবদিকটায় তাকিয়ে দেখে নেয় কতটা স্বস্তি লেগে আছে সেখানে। তারপর কিছুটা আস্বস্ত পায়ে পা টিপে-টিপে ডিবড়ির আলোয় সে এগিয়ে যায় ভোররাতের নিঝুম কলতলার দিকে।
তাড়াহুড়োয় বাসন নামাতে গিয়ে সুরিয়ার হাত থেকে সেদিন ভরণের জামবাটিটা পড়ে গেছিল। নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে শব্দ ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। কলতলার কাছেই টাঁড়ের (উঁচু জমি) ওপর বাবুদের বাসা-লাইন। সেখানে যে প্রান্তিক কাঠের বাসাটি চোখে পড়ে, শব্দের অভিঘাত সে বাসার কাচের জানালায় আছড়ে পড়তেই ঘুম ভাঙে দশ বছরের ছোট্ট একটি ছেলের। ঘুম ভাঙতেই সে বিছানায় উঠে বসে। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করে কোত্থেকে শব্দটা এল। নিস্তব্ধ ঘরের গুমোট বাতাসে ঘুমন্ত বাবা-মা'র শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল ছেলেটার। ঠিক সেই মুহুর্তে কানে আসে চাপাকলের শব্দে জড়ানো কিছু মানুষের কন্ঠস্বর। কৌতূহলী ছেলেটা নিঃশব্দে চৌকি থেকে নামে। নেমে সে জানালায় এসে দাঁড়ায়। এবং পর্দা সরাতেই অন্ধকারে এক অচেনা ছায়াছবি যেন ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়।
দিনের আলোয় অদূরে লেবার-লাইনের (শ্রমিক বস্তি) ঢেরেঙ্গা (ঢালু জমি) ঘেঁষে নিচে যে নির্জন কলতলাটা রোজ চোখে পড়ে, দিনমান সেখানে কেউ তেমন আসে না। কচিৎ কেউ বাসন মেজে ফিরে গেলে সেখানে কাক-শালিখে কিছুক্ষণ ঝগড়ায় মাতে। উড়াল দিতেই পড়ে থাকে নিস্তব্ধতা। সেই জায়গাটায় অন্ধকারে কীসের এতো আলো! ওরা কারা! কাকভোরে আলো জ্বেলেই বা ওরা কী করছে ! ঘুমজড়তা কেটে একসময় ছেলেটা বোঝে ওরা জল নিতে এসেছে। বাসনের শব্দ জানান দেয় যে ওরা বাসন মাজছে। ওদের অস্ফুট স্বরাভাস অলৌকিক বলে মনে হয় ছেলেটার কাছে। ইতস্তত জ্বলন্ত কুপির কালো ধোঁয়া আর কাঁপা-কাঁপা আলোয় কর্মব্যস্ত মানুষগুলোকে মনে হয় ভিনগ্রহ থেকে নেমে আসা কোন অপার্থিব জীব।
দৃশ্যটায় কতক্ষণ আবিষ্ট হয়েছিল ছেলেটির মনে নেই। অজান্তেই দৃষ্টি সরে গিয়ে আটকা পড়েছিল চা সবুজের ঢেউ পেরিয়ে দূর পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে পড়া শরতের আলোয়। কখন যে দিনের আলো ফুটে নিভে গেছে কুপি, মেয়ে-বৌগুলো বাড়ি ফিরে উনুনে আঁচ দিয়েছে ছেলেটা টের পায় না। চালার ভেতর থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী বেরিয়ে এসে মিশে যেতে থাকে ভোরকুয়াশায়। একসময় গনগনে আগুনের আঁচ উনুনের কাঠকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলে ঝিমিয়ে আসে ধোঁয়া।ছেলেটার দৃষ্টি তখন ফেরে মাটির কাছাকাছি। জানালায় মুখ রেখে সে পরিস্কার দেখতে পায় গাছগাছালির ফাঁকে একটি জীর্ণ খোড়ো চালা, চালার মাথায় লতিয়ে ওঠা ঘোঙড়া (ধুঁধুল) ফুল, বাসক গাছে ঘেরা ছোট্ট উঠোন। সদ্য ছাড়া পাওয়া চেঙনা (মুরগির বাচ্চা) মায়ের পেছন পেছন খাবার খুঁটে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে ছেলেটা যতটুকু দেখতে পায় তাতে তার আশ মেটে না। যেটুকু অধরা,অজানা থাকে সেটুক বাকি জীবনের তৃষ্ণা হয়ে লেগে থাকে বুকের ভেতর।
এক আনার পাঁচমেশালি ডালের সাথে কয়েকটা কুন্দ্রি (তেলাকুচা জাতীয় ফল) সেদ্ধ, নয়তো দু'পয়সার সর্ষের তেলে ভাজা ঘোঙরা (ধুঁধুল)-র যৎসামান্য রান্না শেষে সুরিয়ারা কাজে যাওয়ার আগে খেতে বসে মাটির বারান্দায়। রাতের বাসি ভাতে একটুখানি লবন নিয়ে। মরদগুলো যাদের খোয়ারি কাটে নি তখনও ,তারা পড়ে থাকে ঘরের কোনায়। আর যারা কাজে যাবে কি যাবে না ভেবে দোনোমোনেো করে লাট খাচ্ছিল এদিক সেদিক, বৌয়ের ঝামটা শুনে ক্ষেপে গিয়ে হয় ফের হাঁড়িয়ার খোঁজে বেরোয় নয়তো কাঁধে ফাড়ুয়া (কোদাল) বা হাতে হাঁসুয়া (কাস্তে) নিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বের হয় কাজে।
মরদ বেরোলে সুরিয়া তার পাতা তোলার বাঁশের ডোকোয় "কাপড়া-রুমাল" (দু'মিটার যে কাপড়টা বাগানের ভেতর থেকে পাতা তুলে এনে বাইরে রাখা ডোকোয় ভরতে লাগে)টা ভরে নেয়। ভাতের বদলে একটি বোতলে অর্ধেক জল ভরে তাতে ঢেলে নেয় দু'মুঠো চাল। কেননা ভাত নিলে তা গেঁজে ওঠে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। সাথে কচুপাতায় মুড়ে নেয় ধুঁধুল ভাজা বা কুন্দ্রি সেদ্ধ। দুপুরের তোলা পাতা কারখানায় পৌঁছে দিলে বাবুরা পাতা ওজন করে চিঠা (ওজনের পরিমাণ লেখা কাগজ)ধরিয়ে দেয়। তারপর একঘন্টা বিশ্রাম মেলে।সুরিয়ারা তখন ছায়া খুঁজে নেয় গাছের তলায়। সেখানে ছাতা খুলে তাতে ছড়িয়ে দেয় বোতলের চাল। জল ঝরে গিয়ে ভাতের মত ছড়িয়ে পড়ে ফুলে ওঠা সাদা চাল। সেই চাল কচুপাতায় ঢেলে কুন্দ্রি সেদ্ধ দিয়ে পেট ভরায় তারা । এক একদিন ডোকোতে বাড়তি দুটো দড়ি লাগানো বোতলও ভরে নেয় কেউ কেউ। ফেরার পথে কাঁইয়া (মাড়োয়ারি বা বিহারী মুদি)র দোকান থেকে দু'পয়সার খানি-তেল (সর্ষের তেল) আর লালরঙা মাটি-তেল (কেরোসিন) ভরে না আনলে যে পরদিন হাঁড়ি চড়বে না!
কাজে বেরোনোর আগে হাঁটুতক পরনের কাপড়ের ওপর একফালি ত্রিপল জড়িয়ে নেয় সুরিয়া। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা অবধি ভাল করে ডলে নেয় কেরোসিন। যাতে রক্তচোষা ঠেঙ্গি(জোঁক) গুলো চড়তে না পারে পায়ে। তেল মাখা হলে ঢেলা সাবানে হাত ধুয়ে মাটিতে কাপড় পাতে । ঘরের কোণে ঢিলুয়ায় (দোলনা) শোয়ানো ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তুলে শুইয়ে দেয় কাপড়ের ওপর। তারপর বাচ্চা সমেত কাপড়টা বুকে কষে বেঁধে নিয়ে, মাথায় একফালি কাপড় তিনভাঁজ করে তার ওপর ডোকোটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে কাজে। যাওয়ার আগে যাতে কুকুর না ঢোকে তাই টিনের দরজাটা শুধু দড়ি দিয়ে বেঁধে যায়। এভাবেই একের পর এক ঘরগুলো থেকে সুরিয়ার মত আরো অনেকেই বেরিয়ে পড়ে রুজির টানে। কেউ কোলে বাচ্চা নিয়ে , কেউ বা ঝাড়া হাত পায়ে।
শীত, গ্রীষ্ম,বর্ষা সকাল থেকে শেষ বিকেল পর্যন্ত ওরা পাতা তোলে। প্রখর রোদ, অঝোর বর্ষা, মাথার ওপর ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের চমক, পায়ের নিচে সাপ-জোঁক,কখনো মুখোমুখি পড়ে গেলে হিংস্র চিতার আঁচড় সব উপেক্ষা করে ওরা পাতা তোলে। জীবন বিপন্ন করে পেটের দায়ে। দিনমান পাতা তোলার পর শেষবেলার পাতাগুলো পিঠে করে কারখানায় পৌঁছে দিয়ে ওরা আর একমুহূর্ত অপেক্ষা করে না। তখন ওদের হা-ক্লান্ত শরীর গুলোকে ঘর যেন চুম্বকের মত টানে। এক লহমায় বাগানের ভেতর দিয়ে ওরা অদৃশ্য হয়ে যায় বাড়ির পথে।
বাড়ি ফিরে ডোকোটা রেখেই প্রথমে বুকের শিশুটাকে আলগা করে সুরিয়া। সারা দিনে বাচ্চাটা দুবার মাত্র কঁকিয়েছিল। পাতা তুলতে তুলতেই সুরিয়া ওর স্তন গুঁজে দিয়েছিল মুখে। স্তন পেতেই বাচ্চাটা ফের ঘুমিয়ে পড়ে। খাবার আগে ভিজিয়ে ফেলা ন্যাকড়া বদলে দেয়ার সময় হাত-পা নাড়ার খানিক সুযোগ পেয়েছিল বাচ্চাটা। বাকিটা সময় শিশু ক্যাঙ্গারুর মত মুখ গুটিয়ে নিঃসাড় পড়ে ছিল মায়ের ঘামে ভেজা বুকের ভেতর। মাটিতে শুইয়ে দিতেই স্বস্তি পেয়ে সে হাত -পা ছুঁড়তে থাকে। নিজেও তখন ক্লান্ত শরীরটা দেয়ালে ঠেকিয়ে পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে ভেজা চুলগুলো খুলতে থাকে। এরই মধ্যে ওর মরদ এসে ঢোকে ঘরে।
খানিক জিরিয়েই সুরিয়া উঠে পড়ে। উনুনে আঁচ দেয়। সাঁঝবেলায় ফের ধোঁয়ায় ভরে ওঠে আকাশ। চা চাপিয়ে কাপড় ছেড়ে হাত ধুয়ে নেয় উঠোনের কোণে রাখা ভাঙা বালতির জলে। চায়ের জল ফুটতেই কাপড়ে লিকার ছেঁকে তাতে নুন দেয়। তারপর দুটো বাটিতে চা ঢেলে আয়েস করে চুমুক দেয় জনি-মরদে (স্বামী-স্ত্রী)। চা ফুরোতেই সন্ধে নামার আগে ফের ছুটতে হয় সুরিয়াকে কলতলায় জল আনতে।
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মরদ তখন ঘোরাঘুরি করে উঠোনে। মুখে নানাবিধ শব্দ করে পাখি চেনায়। বাচ্চাটা খিলিলিয়ে হাসে। জল নিয়ে ঘরে ঢোকার মুখে এ দৃশ্য দেখে সুরিয়াও হেসে ফেলে।
সন্ধ্যে নামে। সামান্য ভাত ফুটিয়ে নেয় সুরিয়া। খেতে বসার আগে দুজনে মুখোমুখি বসে। ঘরের কোনে রাখা হাড়িয়ার ঘৈলা (হাড়ি) টা নামিয়ে দুটো ভরণের বাটিতে ঢালে। দুহাতে সযত্নে তুলে একটা বাটি মরদকে দিয়ে আরেকটাতে চুমুক দেয় নিজে। সমস্ত দিনের জান নিঙড়ে নেওয়া খাটনির পর ঐ কটূগন্ধী সাদা তরলটুকু যেন সব অবসাদ দূর করে শরীরে ছড়িয়ে দেয় আনন্দ। স্নায়ু জুড়ে খেলা করে স্বর্গীয় অনুভূতি। সামনে ছড়িয়ে দেয়া পায়ের ওপর বাচ্চাটাকে শুইয়ে দোলাতে দোলাতে সারাদিনের নানান জোড়া তাড়া কথার ফাঁকে ওরা হাসে। স্বপ্ন দেখে। একটু বেশি খেয়ে ফেলে কোনোদিন মরদটা বেসামাল হয়ে পড়ে। খাবার জন্য ডাকাডাকি করলেও ওঠে না। নিজে সামান্য মুখে দিয়ে বাকি খাবার টুকু ঢেকে সুরিয়া মাটিতে ইঁট পেতে উঁচু করে রাখা বাঁশের মাচায় বাচ্চাবুকে শুয়ে পড়ে। মুহুর্তে ঘুমের অতলে হারিয়ে যায় সমস্ত চেতনা।
সেদিনের পর থেকে কৌতূহলী ছেলেটা প্রায়ই জানালায় এসে দাঁড়াত। সুরিয়াদের জীবনের টুকরো যাপনচিত্রের কোলাজ দেখতে দেখতে নিজেকে হারাতো। জানালায় দাঁড়ালে শেষ বিকেলে কাজের শেষে সুরিয়ারা যখন উর্ধশ্বাসে বাড়ির পথে ফিরতো সে দৃশ্য দেখে অবাক হতো। শুধু অন্ধকার নামলে যখন আর ওদের দেখতে পেতো না, তখন নানা কৌতূহল জমা হতো বুকের ভেতর। ইচ্ছে হতো একদিন ঐ মানুষগুলোর সাথে গিয়ে সমস্ত দিন,একটা গোটা রাত কাটিয়ে আসে। সে ইচ্ছে যে ওর কোনোদিনই পূরণ হবে না তা সে জানতো। কারণ তার সামাজিক অবস্থান, তার পারিবারিক মর্যাদা কখনোই তাকে সে অনুমতি দেবে না।
তবু চায়ের সবুজ মাটিতে জন্মে, ডুয়ার্স নামক মনোরম ভুখন্ডকে ভালোবেসে সুরিয়াদের সান্নিধ্যেই কেটে যায় ছেলেটির জীবনের চার-কুড়ি বছরের বেশি সময়। যে জীবন আটপৌরে, সহজ সরল, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও যে জীবন জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ, দুঃখভারানত হয়েও যে জীবন জীবনমুখী। চা-সবুজের পাকদণ্ডি বেয়ে দীর্ঘ পথচলার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় জারিত হতে হতে একদিন মানুষটি হয়ে ওঠে এক প্রাচীন ছায়াগাছ। চায়ের অরণ্যে সেই প্রাচীন ছায়াগাছের নাম সত্যপ্রিয়। তাঁর মুখে তাঁরই জীবনের গল্প শোনে এ প্রজন্মের আরেক চা-গন্ধী মানুষ সুবর্ণ।