একান্নবর্তী-১/গৌতম কুমার ভাদুড়ি
একান্নবর্তী-১
গৌতম কুমার ভাদুড়ি
নারী ও নক্ষত্র
বছর দশেক আগে দেশ পত্রিকায় একটা কবিতা পড়েছিলাম- সুজন। আশেপাশে আরও এক সংখ্যায় ওরকমই একটি কবিতা। এত ভালো লেগেছিল যে কবিদের স্বাভাবিক জাত্যাভিমান (আসলে ঈর্ষা ) ভুলে স্ত্রীর সম্মুখেই দু’চার সাহিত্যবন্ধুকে বলেছিলাম- দেখো, আমরাও কবিতা লিখি আর ইনিও। দেশ কেমন খুঁজে খুঁজে কবিতা নির্বাচন করে। এরকম কবিতা তো সারামাস পড়া যায়। আরও কি কি বলেছিলাম মনে নেই, আমার স্ত্রী সেসব মনে রেখেছেন। তো একদিন তিনি দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি এসে বললেন তুমি যে বহুদিন আগে দু’দুখানা কবিতা বিষয়ে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিলে সেগুলোর লেখিকা আমাদের স্কুলের নতুন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম।
মধুমিতা ম্যাডাম। মধুমিতা ভট্টাচার্য। আসানসোল জলপাইগুড়ি গৌহাটি এসব জায়গায় থাকাকালীন ওরকম কবিতা লিখতেন। আবার খুঁজে খুঁজে পড়লাম ওনার কিছু লেখা। সানন্দায় প্রকাশিত একটা গল্প পড়লাম। খুব ভালো লাগল। আমার স্ত্রীর একটা বিশাল দোষ উনি প্রচার করতে পারেন না। এই সুযোগে যদি বলে ফেলতেন- আপনি ভালো লেখেন বটে,আমার তিনিও কম যান না। আরে বাবা, বলো কিছু। নইলে একতরফা হয়ে যায় যে? তো একদিন ফোন নম্বর নিয়ে সাহস করে কথা বললাম।দেখলাম, অত ভয় পাবার মতো কিছু নন, উল্টে বেশ যেন সুরসিকাই মনে হল।নিজেই অনেক কিছু বললেন। মিষ্টভাষিণী। যদিও স্ত্রী ব্যতিরেকে নির্বিশেষ মহিলা সম্পর্কে এটাই আমার এযাবৎ মনে হয়ে আসছিল। তবে না, ম্যাডামের কন্ঠ প্রকৃতই সুমধুর। (এই আবার শুরু হল। কাট।)
ম্যাডাম তারপরেও ক’বার কথা বলেছেন।তো ঘটনা কি, আমার স্ত্রীকে যেহেতু উনি তুমি সম্বোধন করেন ওনার কেন যেন ধারণা হয়েছে তাঁর স্বামীটিও সে অর্থে কচিই হবে, তাই কথার মধ্যে আরে ভাই, আরে ভাই, তোমাদের বয়সে আমরাও অনেক ছুটে বেড়িয়েছি,এখন কি আর সম্ভব, এরকম টোনে কথা বলতেন।একদিন মজা করেই বললাম, আমার পেরিয়ে আসা আয়ুর অঙ্কটা জানেন আপনি? বললাম – যবে তোর তিনি হন, তবে হই আমি। অমনি হো হো করে হেসে উঠলেন,আর সে হাসির সাউন্ড এফেক্ট এতটাই তীব্র ছিল যে সকলে ভেবেছে স্কুল বুঝি এক পিরিয়ড আগেই ছুটি হয়ে গেল। প্রিন্সিপাল এরকমভাবে হেসে ওঠা স্কুলের পক্ষে বিপদজনক অনুমান করে দুচারকথার পর আমিই রেখে দিলাম।
এর পর মাঝে মাঝে কথা হত। বেশির ভাগই পড়াশুনোর কথা, নয় ওনার বাগানের। উনি কোন এক চা বাগানে দীর্ঘদিন থেকেছেন সেখানকার পালাপার্বণ, লোকজনের কথা বলেছেন। দুটি ছেলে বিদেশে থাকে, তাদের এবং তাদের পিতা গৌতমবাবুর বিষয়ে বলেছেন, নিজের কথা একদম নয়।
ম্যাডামকে আমি গার্হস্থরীতি অনুযায়ী অনেকবার বলেছি আসবেন আমাদের বাড়িতে। কর্তাকেও নিয়ে আসতে বলেছি,যদিও মনে মনে সেটা না ঘটুক সে প্রার্থনাও করেছি ,তবু ওই আর কি, নিজেকে একটু ভালো মানুষের কোটিং দেওয়া। যত্নের ত্রুটি খুব একটা হবেনা গ্যারান্টি সত্ত্বেও তাঁদের আর আসা হয়নি। তারও ছোট্ট একটি কারণ আছে। মাঝে আমি ট্রেনের ধাক্কায় (আসলে টোটোর, বলতে কেমন গরিব গরিব লাগে তাই ট্রেনের ধাক্কায় বলি) তিন চারমাস একেবারে ভীষ্মের মতো শরশয্যা বরণ করেছিলাম। ম্যাডাম আমার পরমায়ু স্বল্পতার সম্ভাব্যতা অনুমান করে মায়া বাড়াতে চাননি। পরিচয়সুখ আর অন্তর্ধানশোক পাশাপাশি অবস্থান সর্বদা বর্জনীয়। সুস্থ হয়েছি শুনে স্কুলের দলবল নিয়ে একদিন সত্যিই এলেন।অনেকগুলো ম্যাডামকে সঙ্গে নিয়ে এক বিকেলে ম্যাডাম প্রাসাদতুল্য আমার বাড়ির ঈষৎ জীর্ণ গ্রিলগেটে অবতীর্ণ। প্রতি নমস্কারে বললাম, আসুন, কিন্তু এ যে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের মতো আয়োজন দেখছি। খাবার দাবার সঙ্গে এনেছেন তো? আবার হো হো করে হেসে ওনার সে কি উল্লাস।যথার্থই প্রাণোচ্ছ্বল মানুষ একজন, জড়তার লেশমাত্র নেই চলাফেরায় বাচনে। নিজেই বললেন,ফোনে তো অনেক কথা শুনেছেন,এবারে দেখে কেমন মনে হচ্ছে? বললাম, এত গুণে ভরপুর করে পাঠাবার সময় ভগবান রূপটা আর একটু কম দিলেই পারতেন, অন্যায়ভাবে একজনকেই বেশি দেওয়া হয়ে গেছে। আর সবাই কী বুঝল জানি না, ম্যাডাম তাঁর চায়ের কাপে ডোবানো বিস্কুটটিকে অবিরাম খুঁজেই চলেছেন।
আমার স্ত্রীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ মধুমিতা ম্যাডাম। তাঁর কাছে তো শুনিই, অন্য ম্যাডামদের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি এরকম একজন প্রিন্সিপাল তারা নাকি কোনদিন পায়নি। আমারও খুবই অভিজাত এবং স্বশিক্ষিত বলে মনে হয়েছে ম্যাডামকে। কেউ কখনোই নিন্দের ছলেও কিছু বলেনি ওনার নামে। আমি একবার একজনের একটি কাজের বিষয়ে অন্যের মাধ্যমে ওনার কাছে সামান্য অনুরোধ পেশ করেছিলাম। উনি নিজে ফোন করে খুব শোভন সংলাপে আমাকে বলেছিলেন সাধ্যমতো দেখবেন। শেষ পর্যন্ত তার কাজটি হয়নি। ম্যাডামই সেটা আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন, তাতে আমি একটুও অসন্তুষ্ট হতে পারিনি। স্কুলের সুনামের সঙ্গে আপোস করায় উনি একদম বিরোধী। আমার শ্রদ্ধা বেড়েছে তাতে।
এর পরেও দু দুবার পতিধনকে সঙ্গে করে ম্যাডাম এসেছিলেন আমাদের বাসায়।গান বাজনা গল্পগুজব সবই হয়েছে।দুটো সন্ধ্যা খুব উপভোগ করেছিলাম আমরা।পরে অবশ্য উনি চাকরি ছেড়ে চলে যান। সেই থেকে ফোনেই যা কিছু কথাবার্তা।
নির্মল রসিকতা এবং তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়ায় ম্যাডামের সমকক্ষ আমি আর কাউকে পাইনি। না, না পেয়েছি, আর একজনকে।তার কথা পরে হবে। সত্যিই যে কোনও সমস্যায় ওনার দ্বারস্থ হলেই যে একটা উপায় বেরিয়ে আসবেই এটা কেবল আমার কথা নয়, এ নিয়েই আমাদের সকলের বলাবলি।আমি তো দেখি গানের সুর মিলছে না থেকে শুরু করে ছড়ার অন্ত্যমিল, পাতা দেখিয়ে গাছের নাম,শুকনো পাপড়ি দেখিয়ে ফুলের বংশপরিচয়, আচারের বয়াম কদিন রোদ খাবে সবেতেই মধুমিতা ম্যাডাম। এখনও সুযোগ পেলেই ওনার সঙ্গে একটু কথা বলে ঝরঝরে করে নিই নিজেকে। কিন্তু না, শেষ করি, অনেকেই ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছেন। দুজন তো বুঝি পেজ থেকে বেরিয়েই গেলেন। থামি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴