আমি এক যাযাবর-১/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
পর্ব : ১
শৌভিক কুন্ডা
২০২১, ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ, খবর পেলাম দার্জিলিংএ বরফ পড়ছে। আমার শহরে তখনো ভোর আর সন্ধ্যে ছাড়া, শীতের দেখা নাই রে, শীতের দেখা নাই। তবু উল্লাস। কারণ ২৯ তারিখেই আমার রওনা হওয়ার কথা দারজিলিংএর পথে। আগের থেকেই ঠিক হয়ে আছে। আক্ষেপ মিটলো ২৯ সকাল থেকেই। চোখ মেলেই বুঝতে পারি আজ এ মফস্বলের বাতাসও বেশ ঠান্ডা আঙুল ছুঁইয়ে দিতে শুরু করেছে। শিলিগুড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে মেঘলা হয়ে এলো, ঝুপঝাপ বৃষ্টির সঙ্গতও শুরু। গাড়ির খোঁজ নিতে গিয়ে ঝামেলার শুরু ! যাব যে জায়গাতে তার নাম মিলিং, কালেজ ভ্যালি, দার্জিলিং থেকে ১১ কি.মি দূর, এটুকুই জানা। কোনো ড্রাইভারই দেখি সে অবধি যাবে না, দার্জিলিং যাবে যদিও ! যাই হোক, একটা দিশা এক টাটা সাফারি ড্রাইভারের কাছ থেকে পাওয়া গেল। 'দূর' এই শব্দটা শুনলে মনে হয় 'ছাড়িয়ে' বা 'পেরিয়ে'। বস্তুত আমার গন্তব্যস্থান নাকি দার্জিলিং, এমনকি 'ঘুম'এরও আগে! আরো স্পষ্টভাবে রাস্তা চেনাতে চাইলে রংবুল বলাটাই ভালো। সেখান থেকেই নীচে নেমে গ্যাছে মিলিং যাওয়ার পথ। তাহলে কোনো গাড়ি যাবে না কেন? উত্তরটা বরং পরে দিই।
রংবুল পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। অথচ এনজেপি থেকে যখন রওনা হয়েছি, তখন সবে দুপুর। যে বরফে আহ্লাদিত হবো বলে ছুট দিয়েছি, সেটাই কাল হ'ল! দার্জিলিং যাওয়ার একটি মাত্র রাস্তাই ওঠানামার যোগ্য হয়ে আছে এই আবহাওয়ায়, ফলে গাড়ি যেমন আস্তে চলছে, তেমনই জ্যাম। সে ঠোক্কর এমনকি সমতল থেকেই শুরু। সমতলভাগের শেষ প্রান্ত শিমুলবাড়িতেই দাঁড়াতে হল দেড় ঘন্টার ওপর। সে অনন্ত জট যদি বা কাটল একসময়, রোহিনীতে একটা খাওয়ার স্টপ দিতেই হ'ল।
এর পর থেকে কারশিয়ং অব্দি অবশ্য রাস্তার কখনো ডান কখনো বাঁ দিকের ছবি বরাবরের মতোই মন ভালো করা। একটানা থমকে থমকে চলার যে বিরক্তি মনের ভেতর জমে উঠছিল, অন্ধকারে ফুটে ওঠা অনেক নীচের সমতলরোশনাই তাকে দূরে সরালো, যেমন চোখের নাগালে স্পষ্ট হতে থাকা কারশিয়ংএর নেকলেস! একটু ঝিমুনিও এসে গেছিল, চটকা ভাঙলো ড্রাইভারের ডাকে, রংবুল এসে গ্যাছে। এ গাড়ি আর যাবে না। রংবুল ফটকের পাশ দিয়ে নীচের দিকে গড়িয়েছে মিলিংএর রাস্তা। কিন্তু ঘোর হয়ে আসা সন্ধেয় নির্জন পাহাড়ি লোকালয়ে গাড়ি কোথায়! দেবদূতের মতোই পৌঁছল চিরাগ। "পঁহছ গ্যয়ে?" রাস্তায় একবার ফোন এসেছিলো বটে। তার ভিত্তিতেই সময় হিসেব করে মুসকিল আসানের এই চমক! এবার বলে ফেলি বছরশেষের এই দিকশূন্যপুর যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য। একটা সংস্থার ক্যাম্প আউট বস্তুত। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ক্যাম্পাররা আসেন। দু'দিনের কম্যুনিটি জীবন। স্মৃতি বুকে নিয়ে ফিরে ফিরে যাওয়া নিজ নিকেতনে। আবারও দেখা হবে এই বিশ্বাস সাথে থাকে প্রতি বছর। যাক, চিরাগের সাথে আবার গাড়িতে ওঠা, এবং পাহাড়ি ঢালে গড়িয়ে নামা। পরিচয় হ'ল ওড়িশা, মহারাষ্ট্র থেকে আসা আরও চারজনের সাথে গাড়িতেই। তাঁরাও আমারই মতো রংবুলে এসে চিরাগের হেফাজতে জমা পড়েছেন। গল্পের থেকে যখনই বের হই, খেয়ালে আসে, কেবল ঢালই নয়, মুহুর্ত পরপরই হেয়ারপিন বেন্ড! হেডলাইটের দৌলতে যে সামান্যটুকু চোখের নাগালে আসছে সে সব বাঁকের এবং ঢালের, দাঁতে দাঁত চেপে সকলেই বোধহয় ইষ্টনাম জপ করছিলাম!
রংবুল থেকে মিলিং প্রায় ৪৫ মিনিটে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে নামতেই ঝুপঝুপ বৃষ্টি। চারপাশটাকে যে ভালো করে দেখবো, তার উপায় রইল না! পাহাড়ের রীতি অনুযায়ী রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি, চিরাগের তাড়নায় আরো হুটোপুটি, তারপর মাথার ওপরে ছাদ এবং শরীর ফেলার জন্য ম্যাট্রেসের ব্যবস্থা হতেই সারাদিনের ক্লান্ত শরীরগুলো অঘোর ঘুমে মুহুর্তের মধ্যে! ঘুমের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে রাতজাগা পাখির হঠাৎ ডেকে ওঠা, বয়ে চলা জলের কলধ্বনি, বাতাসের ঘন ঘন ওঠাপড়া আর অবিশ্রান্ত বৃষ্টির গান।
ঘুম ভেঙেছিল পরদিন খুব ভোরে। নাম না জানা পাখির ডাকে। ফলে বের হতে হলো। যে কোনো জায়গায় প্রথমবার গেলেই এটা হয় আমার। ঘুম ভাঙলেই চারপাশটা দেখে নিতে ইচ্ছে করে। ঘরের বাইরে পা রাখতেই কনকনে ঠান্ডা মুখেহাতে কেটে বসলো। একটু সইয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের দুদিনের ক্যাম্পিং এ চত্বরেই শুরু হবে বিকেল তিনটে থেকে। বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁবুগুলো তাকিয়ে আছে পাহাড়ি ঢালের ঘন সবুজ চা বাগানের দিকে। আর তাঁবুদের পেছনে, একটু নীচু জমির বুক ছিঁড়ে বয়ে চলেছে বালাসন। শেষ ডিসেম্বরের শীতে তার পরিচিত বৈভব নেই বটে, পাহাড়িচালের খরস্রোত তবু সরু ধারায় হলেও অস্তিত্বের জানকারি দেয়। ওপারে জঙ্গল। ব্রেকফাস্টের পর আব্দুলরা বায়না ধরলো টাইগার হিল যাবে। যতই বোঝাই এত বেলায় এবং এরকম আবহাওয়ায় সেখানে গিয়ে লাভ নেই কোনো, পাগলদের দল মানলে তো! শুধু যে গেল তাই নয়, আমাকেও গাড়িতে তুলে নিল জোর খাটিয়ে। রংবুল থেকে এবার গাড়ি উঁচুর দিকে হাঁটল। ড্রাইভার জানালো ঘুম থেকেই বরফ পেয়ে যাব।
সকালে, রওনা হওয়ার আগে, চিরাগ বলেছিলো আজ রোদ উঠছে, কালকের চেয়েও বেশি ঠান্ডা পড়বে। বরফ গলবে যে! তো সেই রোদের আভাস কিন্তু রংবুল পৌঁছনোর আগেই কোথাও মুখ লুকালো। কনকনে ঠান্ডা বাতাস আর টিপটিপ বৃষ্টি। তার মধ্যে চলতে হচ্ছে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে, গতকাল থেকেই এ পাহারপথের চেনা ছবি! প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে কুড়ি মিনিটের পথ উজিয়ে ঘুম পৌঁছাতে পারলাম। প্রথম চোখে এবং খেয়ালেও, এলো নীলেরই। দার্জিলিংএই কলেজকাল কেটেছিল ওর, ফলে পুরনো হলেও চেনা ছবি চোখে ধরা দিচ্ছে বুঝি। আমরাও বুঝতে শুরু করলাম বৃষ্টির মতো যা ঝরে পড়েও কিছুক্ষণ লেগে থেকে তার পর উইন্ডস্ক্রীন বেয়ে নেমে যাচ্ছে, উড়ো তুলোর মতো বাতাসে ভাসছে কখনো, আবার যেন সাদা মেঘের দল হয়ে হাত ধরাধরি করে নেমে আসছে রাস্তার ওপর, তা আসলে পাহাড়ি শহরের বিখ্যাত সেই স্নো ফল!
প্রথম দিকের অনেকটা সময় ছবি তুলে, ভিডিও করে কাটলো, কিন্তু ঘুম স্টেশন থেকে পেট্রোল পাম্প অব্দি গাড়ি চললো শামুকের পায়ে। আর পাম্পের সামনে সেই যে দাঁড়িয়ে পড়লো, তারপর একেবারেই নট নড়নচড়ন! ঘড়ি দেখছি বারবার। অন্য সব ক্যাম্পাররা, বিশেষ করে কাছাকাছি এলাকার যারা, নিশ্চয়ই পৌঁছতে শুরু করেছে। অনুষ্ঠানও শুরু হয়ে যাবে সময়মতো। এদিকে আব্দুলরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাইগার হিল নয়, ওরা দার্জিলিংএ যাবে! প্রমাদ গনলাম। যা জ্যাম, তাতে দার্জিলিং কোনো একসময় পৌঁছনো গেলেও ফিরতে রাত হয়ে যাবে। ফলে প্রথমদিনের ক্যাম্পিংই মিস করবো। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে ঘড়ি দেখছি আর অধৈর্য হয়ে উঠছি, শেষমেষ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। আমি ফিরে যাবো। ওরা সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলেও, বাঙালের গোঁ। হঠাৎ দেখি নীলও নেমে পড়ল। দুই বাঙালে রওনা হলাম পায়দল। ভাগ্য ভালো, ঘুম স্টেশনের আগেই ওমুখো গাড়ি পেয়ে গেলাম একটা। রংবুল অব্দি নিশ্চিন্ত। কিন্তু নামতে নামতে সে গাড়ির ড্রাইভারও যখন জানলো আমাদের গন্তব্য মিলিং, সে-ও হাঁ হয়ে গেল! হয়তো দয়াও হ'ল কিছুটা। রংবুল পৌঁছে নিজেই খোঁজ খবর নিতে শুরু করল, এবং জানা গেলো মিলিং যাওয়ার জন্য দিনের একমাত্র গাড়িটি একটু আগেই ছেড়ে চলে গেছে! যাত্রার শুরুতেই মিলিংএর গাড়ি না পাওয়ার কারণটা এতক্ষণে পরিষ্কার হতে শুরু করলো। এতটাই জনবিরল জায়গাটি, এবং রাস্তাতে এত এত জিলিপির প্যাঁচ, ফেরার পথে যাত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা যেখানে শূন্য, সেপথে আর যায় কোন আহাম্মক?
নামবো নামবো করছি, এমন সময় মাথায় খেললো, গাড়ির মুখটি তো সোনাদার দিকে নয়, বরং আমরা যে পথে নামবো, সেদিকেই ঘুরিয়ে রাখা! জিজ্ঞেস করলাম চালককে তিনি কোথায় যাচ্ছেন। জবাব পেলাম, মিলিং যাবেন না! সেটা তো আগেই জেনেছি, কিন্তু যাবেনটা কোন মুল্লুকে, একথা জিজ্ঞেস করার আগেই দয়ালু ড্রাইভার রা কাড়লেন, "ঠিক হ্যায়, ম্যয় আপলোঁগোকো ধোত্রে তক পহছ দেতা হুঁ, লেকিন উসকে বাদ পায়দল যানা পড়েগা।" মরুভূমির বাজারে মেঘ না চাইতে জল! আরো কিছুদূর গড়ালো গাড়ি, তার পর এক বাঁকে পৌঁছে ঘ্যাঁচ! ব্রেক। ড্রাইভার ভাই নীচের দিকে নেমে যাওয়া বাঁ হাতি রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, সেটাই মিলিং যাওয়ার এক এবং একমাত্র উপায়।
অতএব নীল আর আমি নেমে পড়লাম। ড্রাইভারজী আমাদের টা-টা করে সোজা ছুটলেন। হাতে আঁকা তির চিহ্ন দিয়ে ক্যাম্পের পথ নির্দেশ করা আছে দেখতে পেলাম বাঁ হাতে নেমে যাওয়া রাস্তার মুখে। কিন্তু পাহাড়ি পথে আগেও হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এতে খুব একটা উল্লসিত হতে দেয় নি। হতেই পারে যে বেগুসরাইএর পথনির্দেশ টাঙানো আছে বড়বাজার মোড়ে! আমরা দুজন ছাড়া ঢলে পড়া দুপুরে একটিও আর প্রাণী নেই রাস্তায়। কাউকে জিজ্ঞেস করে কোনো চোরবাটো যে পেয়ে যাবো তারও উপায় অতএব নেই। কি আর করা যায়, নিঝঝুম রাস্তা ধরে নীচের দিকে হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর নেই দুই ক্যাম্পারের। এত নীরব, এত নির্জন, অথচ এতই উদাসীন রাস্তা, যে মনে হয় সৃষ্টির আদি থেকেই এ পথ এমনই বয়ে গ্যাছে, এখানে ঘটে না কিছু, কোনো প্রত্যাশাও নেই কারো কাছে! নীল মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছে, ও আবার ফটো শিকারী। প্রথম প্রথম এই থেমে থমকে চলাটা খারাপ লাগছিলো না, কিন্তু সময় যত যায়, পা তত ভেঙে আসছে। সেভাবেই প্রায় অনন্তক্ষণ চলার পরও ক্যাম্পের কোনো হদিশ মেলে না অন্তত চোখের সীমায়। এ দিকে ক্ষিদেয় তখন পেট চুঁই চুঁই করছে। দিশা না পেয়ে তাই হেঁটেই চলেছি। হঠাৎ পেছন থেকে গাড়ির শব্দ। দাঁড়িয়ে পড়ি। এবং গাড়ি এসে আমাদের পাশেই থামে। নেমে আসে সিকিমের মিংমা আর বাংলাদেশের অপু! আমাদের ক্যাম্পের আরো দুই অংশীদার! ভাগ্যিস ওদের রওনা হতে সময় লেগেছিলো! এর পরের কথা সংক্ষিপ্ত। ক্যাম্পে পৌঁছে বরফিলা বাতাসে ততক্ষণে হিম হয়ে যাওয়া ভাত, মাশরুম পকোড়া আর চিকেন। ক্ষিদের মুখে অমৃত তা-ই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴