অন্তহীন আকাশের নীচে-১
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ১
দেবপ্রিয়া সরকার
=====================
ধুসর
মেঘে ঢাকা পড়েছে আকাশ। পশলা পশলা বিরামহীন বৃষ্টির শব্দ ; জোলো হাওয়ার
ঝাপটা মনে করাচ্ছে অজস্র অতীত দিনের কথা। কাকভেজা পাখপাখালির দল এসে বসছে
ছাদের কার্ণিশে আবার উড়াল দিচ্ছে কখন যেন! মেঘবৃষ্টির রক্তচক্ষু উপেক্ষা
করে ছুটে চলেছে জীবন। ঘরের পাশের রাস্তার জমা জল ছপাত্ ছপাত্ শব্দে মারিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে একদল দামাল কিশোরকিশোরী। তাদের কলকল করে বলে যাওয়া কথার কাকলি
ছাপিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির আওয়াজকেও। দূরে বড় রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে অজস্র
গাড়ি। কারও চলার কোনও বিরাম নেই। যত বিরতি, বিশ্রাম যেন আশ্রয় পেয়েছে তাঁর
কাছে। সময়ের চাকা স্থবির হয়েছে তাঁর দোরগোড়ায়। অথচ নিঃস্পন্দ দিঘির জলও আজ
চঞ্চল। অবিরাম বৃষ্টিফোটা ঝরে পড়ে আঁকিবুঁকি কাটছে জলের ওপর। শুধু ঊষারানীই
এই গতিময় সময়ে চলচ্ছক্তিহীন। ধারাস্নানে মেতে থাকা সবুজ গাছগাছালির দিকে
অপলোকে চেয়ে আছেন এবং ভেবে চলেছেন কত কত কথা! হারিয়ে যাওয়া সময় এসে কড়া
নাড়ছে তার মনের দ্বারপ্রান্তে। স্মৃতিপটে ফিকে হয়ে আসা অগুন্তি মানুষের মুখ
একঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশা মাখা কোনও কৃষ্ণগহ্বরে। আর তো
জীবনে কিছু নেই, শুধু ওই স্মৃতিটুকু সম্বল।
পুরনো
বাড়ির নোনাধরা দেওয়াল ঘেরা ঘরে একলা বসে ঊষারানী রোমন্থন করেন পুরনো কথা।
ফেলে আসা দিনের ভেতর খুঁজে পান বেঁচে থাকার রসদ। রোজ একটা একটা করে দিন
গোনেন ঊষারানী। খাটের পাশের খোলা জানালা দিয়ে যখন সূর্যের আলো ঘরে ঢোকে
অথবা নিতাইদের মোরগটা কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে তখন দিন শুরু হয় তাঁর। সারাদিন
মানুষ বলতে ওই এক বকুল। তারওপর ভার ঊষারানীর দেখাশোনা করার। বাড়ির অন্য
মানুষ মানে তাঁর ছেলে রাঘবেন্দ্র এবং পুত্রবধূ জয়শীলা দিনভর নিজেদের নিয়েই
ব্যস্ত। তাদেরও বয়স কম হল না। রোগজ্বালায় জর্জরিত। সারাদিনে একবার হয়তো
আসে ঊষারানীর ঘরে খবরাখবর নিতে। নাতি কলকাতা শহরে চাকরি নিয়ে সংসার পেতেছে।
ছুটিছাটায় দু’এক দিনের জন্যে বাড়ি আসে। মেজছেলে সত্যেন্দ্র বিদেশে বড়
ডাক্তার। এক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছিল বাড়ির অমতে। সেই থেকে সম্পর্ক নেই
বললেই চলে। আজ প্রায় দশ বছর আসেনি এ’দেশে। ছোটছেলে দেবেন্দ্র যুবাবয়সেই
মারা গিয়েছে অ্যাকসিডেন্টে। একমাত্র মেয়ে সঞ্জীবনী বাসা বেঁধেছে দূর শহরে।
মাকে দেখতে আসার ফুরসৎ তারও নেই।
তবু ঊষারানী নিরন্তর
ভাবনায় ডুবে থাকেন। আপনজনদের কাছে পাওয়ার ইচ্ছেয় আকুলিবিকুলি করে মন।
তাদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য সারাক্ষণ বকুলকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেন ঊষারানী।
বকুল মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ভারি তো দরদ তোমার! কেউ একটা উঁকি দিতেও আসে না।
কবে থেকে বলছি দুই দিন ছুটি চাই, তাও দিতে চায়না বৌদি। বলে, “বকুল তুই না
থাকলে মাকে কে দেখবে?” যেন আমিই তোমার পেটে ধরা মেয়ে। পয়সা দেয় বলে যত
দায়িত্ব আমার! আর ওদের কিচ্ছু নেই। যত্তসব ফেরেববাজি!
বকুলের
কথা শুনে মুষড়ে পড়েন ঊষারানী। অস্ফুট স্বরে নিজের খেয়ালে কী যেন বিড়বিড়
করে যান। মদনমোহনের কাছে দিনরাত প্রার্থনা করেন তাঁকে তুলে নেওয়ার। এই
জরাগ্রস্ত জীবন আর ভাললাগে না। তাঁর সমবয়সীরা একে একে সকলে চলে গেল। শুধু
রয়ে গেলেন তিনি দুঃসহ একাকীত্বের ভার বহনের জন্য। স্বামী অমরেন্দ্রও কতকাল
আগে চলে গিয়েছেন। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছেন ঊষারানী। আজকাল
অমরেন্দ্রর মুখটাও মনে পড়ে না ঠিকঠাক। যতদিন হাত-পা সচল ছিল সংসারের অনেক
কাজ তিনি করে ফেলতেন। কিন্তু যত সময় ফুরিয়ে আসছে তত অচল হচ্ছে
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সেদ্ধ ভাত-তরকারির বেশি আজকাল আর কিছু হজম হয় না। আজও বকুল
জোর করে গিলিয়ে গেল কিছু বিস্বাদ পাঁচন। কোনও রকমে একটা অতৃপ্তির ঢেঁকুর
তুলে ঊষারানী খাটের ওপর শরীর এলিয়ে দিলেন।
বৃষ্টিটা
এখন ধরে এসেছে। মেঘ ছেঁড়া রোদ বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। একটা দোয়েল শিস
দিচ্ছে অনবরত। ঠান্ডা ভেজা বাতাস হু হু করে জানালা দিয়ে ঢুকছে। বালিশে মাথা
রেখে দুচোখ বন্ধ করলেন ঊষারানী। মানসপটে ভেসে উঠছে ছবির মতো সুন্দর
রাজপ্রাসাদ, বড় বড় ঝাড়বাতি, চোখধাঁধাঁনো আসবাব আর এক ফর্সা টুকটুকে
সমুদ্রের মতো গভীর চোখের রাজকন্যা...ফুরিয়ে যেতে যেতেও কিছু স্বপ্ন ফুরায়
না; হারিয়ে যেতে যেতেও কিছু স্মৃতি রয়ে যায় মনের কোনও এক চোরাকুঠুরির
অন্দরে। সুযোগ পেলেই তারা বেরিয়ে আসে চুপিচুপি। একরাশ আনন্দ ছড়িয়ে দিয়ে
যায় স্বপ্নদর্শীর চেতনে, মননে।
বকুল বাসনপত্র গুছিয়ে
ঘরে এসে দেখে গভীর ঘুমে মগ্ন ঊষারানী। সারামুখে শিশুর মতো সারল্য ছড়িয়ে
আছে। মাঝে মাঝে হেসে উঠছেন অবচেতনে। ঠিক যেন ঘুমন্ত শিশুর দেয়ালা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴