রাবণ/স্বর্ণজিৎ ভদ্র
রাবণ
স্বর্ণজিৎ ভদ্র
সকালে নগর কীর্তনে ঘুম ভাঙে বাসন্তীর। ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নে সারারাত তেমন ঘুম হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল চিন্তা করে। টিনের ফাঁক দিয়ে ঢোকা আলোয় ঘরটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলে বাসন্তী উঠে পড়ে। ছাগল দুটিকে বের করে সুপারি গাছের সঙ্গে বেঁধে একটি কাঁঠালের ডাল সামনে দেয়। আজ উঠান ঝাড়তে দিতে অনেক সময় লেগে যায়। মাঝে মাঝেই হাতের ঝাঁটা থেমে যাচ্ছিল। গতকাল নারকেল পাতা থেকে কিছু শলা বের করে ছিল, এখনো অনেক পড়ে আছে। আজ আর সেদিকে যায় না বাসন্তী। আলাদা করা শলা গুলিকে বারান্দার নীচু টিনের চালে শুকাতে দেয়। মাচা থেকে কয়েকটা কচি লাউয়ের ডগা কেটে এনে কুটতে বসে। জগন্নাথ যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন বাসন্তীর ভাতের হাঁড়িতে উতাল এসে গেছে। সেই ছোটোবেলা থেকেই গরম ভাতের গন্ধ বড়ো ভালো লাগে বাসন্তীর। দুবার জোরে জোরে শ্বাস নেয়। জগন্নাথ চৌকির তল থেকে টিনের ট্রাঙ্কটা বের করেছে বারান্দায়। সেদিন জলপাইগুড়ি থেকে কিছু নতুন মাল এনেছে৷ ব্যাগ থেকে সেগুলি এখন ট্রাঙ্কে ভরছে। "মনিহারি" শব্দটা মনে মনে বলে ওঠে বাসন্তী। জগন্নাথের বাপও নাকি এই ব্যবসা করত। সারাবছর মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়াত। জগন্নাথও ছোটো থাকতে বাপের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। কিন্তু দিন দিন এইসব জিনিসের চাহিদা কমে যাওয়াতে আর আগের মতো লাভ হতো না বলে জগন্নাথ বাইরে চলে যায়। তবে ওর বাপ অবশ্য মরার আগে পর্যন্ত এই কাজই করে গেছে। মাঝে বেশ কয়েক বছর এই ট্রাঙ্ক আর খোলা হয়নি। শেষে বিয়ের পর জগন্নাথই আবার উদ্যোগ নিয়ে এই কাজ শুরু করে। বলে, পিতৃপুরুষের ব্যবসা, না করলে ওদের কষ্ট হবে। তবে এখন আর সারাবছর মেলার মেলায় ঘোরা হয় না। আসে পাশের কয়েকটি মেলাতেই যা যাওয়া। সেই রথের মেলার পর আজ আবার দশমীর মেলাতে।
ভাত খেয়ে আর দেরি করে না জগন্নাথ। দুজনে মিলে ধরাধরি করে ট্রাঙ্কটা ভ্যানে তোলে। ত্রিপলটা ভাঁজ করতে করতে জগন্নাথ বলে,
-শুনচো, শাবলটারে আইনা দাও।
-কেন, কাইল যে কইলা বাঁশ বলে পুইতে আসছ?
-তবু নিয়া যাই, কওয়া তো যায় না। আইজ যদি আবার কোন কাজে লাইগা যায়।
জগন্নাথ কাঁচা রাস্তায় ভ্যানটা কষ্ট করে টেনে নিয়ে বেড মিশালি রাস্তায় তোলে। সিটে বসে প্যাডেল চালিয়ে বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে ক্রমশ মিলিয়ে যায়। বাসন্তীর নির্বাক দৃষ্টি শূণ্য পথে নিবন্ধ থাকে দীর্ঘক্ষণ।
স্নান করে বাসন্তী একটা নতুন শাড়ি পড়ে। পায়ে মোটা করে আলতা দেয়। কপালের মাঝে বড়ো করে সিঁদুরের টিপ আঁকে। তেল সিঁদুর দিয়ে সাজানো বরণের থালাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দুপুরের রোদ এখনও বেশ কড়া। এবার আর অধিকারী বাড়ির দিকে যায় না বাসন্তী। আলপথে প্রাইমারি স্কুলের পেছনের রাস্তা ধরে। ক্লাবের প্যান্ডেলে তেমন লোকজন নেই। ভেতরে কয়েকটা অল্পবয়স্ক ছেলে এক কোনে চেয়ারে বসে কি যেন করছে। দু চারটা বাচ্চা এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। দুটি অচেনা বউ উপরে ঠাকুরের মঞ্চে। বাসন্তী চারদিকে আর একবার চেয়ে নিয়ে খুব ধীরে ধীরে তক্তার সিঁড়ি দিয়ে ঠাকুরের মঞ্চে ওঠে। নীচে পুরুতমশাই গত কয়দিনের পাওয়া প্রণামীর শাড়ি নারকেল ফলমূল সব আলাদা আলাদা গুছিয়ে রাখছে। অসুরের কাঁধে রাখা মা দুর্গার এক পা। নতুন কেনা সিঁদুরের কৌটোটা মায়ের পায়ে ছোঁয়াতেই হাতটা কেঁপে ওঠে বাসন্তীর। পেছনে মণিকান্তের গলা। বাসন্তী নীচে নামলে মনিকান্ত একটা ছেলেকে ডাক দিয়ে বাসন্তীকে দেখিয়ে বলে
"যা, ওকে একটা ভোগের হাঁড়ি বের করে দে।"
মণিকান্ত ওদের সাথে সাথেই প্যান্ডেলের পেছনে থাকা ক্লাব ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢাকা একটা মাটির হাঁড়ি এনে ছেলেটি বাসন্তীর হাতে দেয়।
-আরে একটা ক্যারিব্যাগে ভরে তো দিবি। এই ভাবে হাতে করে কিভাবে নিয়ে যাবে?
--ক্যারিব্যাগ তো নাই দাদা।
মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে মণিকান্ত ছেলেটির হাতে দেয়।
-যা, বাজার থেকে ক্যারিব্যাগ নিয়ে আয়। আর শোন, এক প্যাকেট সিগারেট আনিস আমার টা। জানিস তো?
ছেলেটা মাথা নেড়ে চলে যায়।
প্যান্ডেলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে মণিকান্ত একটা সিগারেট ধরায়।
- তাহলে ওটাই ফাইনাল তো।
বাসন্তী খুব মৃদু স্বরে সম্মতি জানায়।
- দেখ, পরে কিন্তু গড়বড় করে দিসনা। না হলে বল, আমার লোক আছে। কাজ হয়ে যাবে, কাক পক্ষীও টের পাবে না।
দুটি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ছাড়া সরু সাদা ধোঁয়া অনেক দূর ঠেলে দেয় মণিকান্ত।
- না, যেইটা কথা হয়ে আছে সেইটাই হবে। আপনি এত চিন্তা করতেছেন কেন? আপনি শুধু সঙ্গে থাইকেন তাইলেই হবে।
- আরে আমি তো আছিই। সারাজীবন তোর পাশে থাকব বলেই তো এত সব করতে হচ্ছে।
বাসন্তীর কথা মতো মণিকান্ত রাত নয়টা নাগাদ বাইক নিয়ে বের হয়। মেলার মাঠের কিছুটা আগে বাদিকে একটা সরু কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। মনিকান্ত সেটা ধরে। কিছুটা যাবার পর রাস্তাটা উঁচু রেল লাইনের ধারে শেষ হয়েছে। এর পর লাইনের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা আাছে তাতে বাইক চালাতে হবে খুব সাবধানে। চাকার দাগের সরু মাটির পথ থেকে পাশের উঁচু ঘাসে উঠলেই পড়ে যাবার সম্ভাবনা। গতকাল দিনেরবেলা এসে মণিকান্ত ভালো করে সব দেখে গেছে। কিছুটা যাবার পরেই পুরোনো কেবিন ঘরটা চোখে পড়ে। বাইক রেখে খাড়া ঢাল বেয়ে মণিকান্ত বেশ কষ্ট করেই উপরে উঠে আসে। রেললাইনের ওপাশের মাঠেই মেলা হচ্ছে। লাইনটা পার করে কেবিন ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় মণিকান্ত। এদিকের মতো ওদিকের নীচেও একটা রাস্তা আছে। তবে এখন ঢালের গায়ের জঙ্গল আর অন্ধকারে তা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। মেলার মাঠের বিশাল রাবণের মূর্তিটা যেন মনিকান্তর দিকেই তাকিয়ে আছে। নীচের এই রাস্তা দিয়েই জগন্নাথ যাবে কোন এক আত্মীয় বাড়িতে। সেখানে সব জিনিসপত্র রেখে এই রাস্তাতেই ফিরবে। মেলা চলাকালীন কয়দিন নাকি এমনই করে ও। ফেরার পথেই ওদের কাজ সারতে হবে। বাসন্তীর উপর অবশ্য মনিকান্ত পুরোপুরি ভরসা করতে পারেনি৷ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একবার জিনিসটা দেখে নেয়। এটার লাইসেন্স নেই, চালিযে দিলেও সমস্যা হবে না। তবে লাসটাকে এই উঁচুতে তুলতে কষ্ট হবে। বাসন্তীর প্ল্যান অনুযায়ী জগন্নাথের বডি লাইনের উপর ফেলে রাখা হবে। বডির উপর দিয়ে ট্রেন গেলেই ব্যস, নিখুঁত পরিকল্পনা। না, মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে মানতে হবে। এই মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ঝেড়ে ফেলতে হবে৷ বাসন্তী জানে এরপর মনিকান্ত ওকে বিয়ে করবে। তখন ওরা আর এখানে থাকবে না। ওকে নিয়ে শিলিগুড়ির ফ্ল্যাটে উঠবে। মনে মনে একটু হাসে মনিকান্ত । হ্যাঁ, বাসন্তীকে ও শিলিগুড়ির ফ্ল্যাটেই রাখবে। ওখানে আরও দুটি মেয়ে আছে, আপাতত ওদের সাথেই থাকবে। তারপর দূরে কোথায়। প্রথম প্রথম বেটির খুব দেমাক ছিল। তবে মনিকান্তও এই লাইনে বড়ো খিলাড়ি, জানে কোন মাছ কি ভাবে খেলিয়ে তুলতে হয়।
সন্ধ্যার পর বাসন্তী মেলাতে এলে জগন্নাথ বাসন্তীকে সঙ্গে নিয়ে আশেপাশের দোকান ঘুরে সংসারের টুকিটাকি জিনিসি কেনে। জিলাপি খায়। তারপর দোকানের জিম্মা বাসন্তীকে দিয়ে বলে,
- যাই সামনা থেকে রাবণটারে দেইখে আসি। আগুন দিবার সময় হয়ে আসতেছে।
অনেকক্ষন হল জগন্নাথের যাবার। এতক্ষণে ফিরে আসার কথা। না, আর সময় নষ্ট করা যাবে না। মণিকান্ত চলে গেলে সব মাটি হয়ে যাবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। দ্রুত দোকান গুটিয়ে ফেলে বাসন্তী। পাশের দোকানে ট্রাঙ্কটা রেখে শেষ বারের মতো পেছনে একবার দেখে, তারপর দ্রুত পায়ে চলতে শুরু করে।
মোবাইলে দশটা আঠারো। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়াতে মনিকান্ত এখন নীচের রাস্তাটা ভালোই দেখতে পাচ্ছে। জগন্নাথের এত দেরি হচ্ছে কেন? ও গেলে তবেই বাসন্তী আসবে। রাবণে এবার আগুন দেওয়া হয়েছে মনে হয়। নানা ধরনের বাজি ফাটছে রাবণের ওখানে। মণিকান্ত একটু এগিয়ে যায়, রাবণ বধ হবে। হঠাৎ মাথার পেছনে এক তীব্র আঘাত। মুহুর্তে হাজার বাজির আলো সরে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসে।
আগাছার জঙ্গল ধরে নিঃশব্দে রেললাইনে উঠে আসে বাসন্তী। সদ্য কেনা দাঁ-টা আঁচলের তলে শক্ত করে ধরে কেবিন ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় মণিকান্ত? চলে গেছে? নাকি আসে নাই? মাথাটা দপদপ করে। মেলায় জ্বলতে থাকা রাবণের গা থেকে বাজি আকাশে উঠে ক্ৰমাগত ঝরঝর করে ফেটে পড়ছে। বাজির ঝলকানিতে ঠান্ডা স্রোত নামে বাসন্তীর পিঠে। লাইনের উপর ওটা কি পড়ে আছে? বাসন্তীর হাত থেকে দাঁ-টা খসে পড়ে। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার আগে বাসন্তীর হাতটা কে যেন টেনে ধরে। পেছনে তাকায় বাসন্তী। রাবণ পোড়া আলোতে দেখে 'জগন্নাথ'। হাতে ওর দেওয়া সেই শাবলটা। চোখ বন্ধ করে বাসন্তী মাথা রাখে জগন্নাথের বুকে। মনে হল অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে খুব চেনা এক অস্ফুট স্বর
-বোকা মাইয়া, রাবণরে কি সীতা বধ করছিল? ঐ দেখ টেরেন আসতেছে। এইবার হবে আসল রাবণ বধ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴