ভাসান/রাজীব দে রায়
ভাসান
রাজীব দে রায়
মেয়েটির মুখখানি একেবারে দেবী দুর্গার মতো। অমন টানা দুই চোখ সচরাচর দেখা যায় না। চোখের পাতাগুলোও যেন ঈশ্বর আপন হাতে এঁকে দিয়েছেন। চোখদুটোর দুই প্রান্ত উত্তর-পূর্ব ভারতের মেয়েদের চোখের মতো, অনেকটা বিস্তৃত। তবে, এদিককার মেয়েদের চোখ যেমন সরু আর বিস্তারে রাজকীয় খঞ্জরের মত টিকালো হয়, ঠিক তেমনটা নয়। বরং, বলা যায়, মেয়েটির দুই চোখ পদ্মার ডিমভরা ইলিশের মতো। দুই প্রান্তদেশ সরু হয়ে ডাকের সাজের চোখের মতো আয়ত ও বিস্তৃত। দুধসাদা চোখের মাঝখানে খয়েরি-কালো উভয় রঙের মিশ্রণে নির্মিত দুটো অক্ষিগোলক। ভালো করে নজর করলে বোঝা যায়, মেয়েটি আসলে লক্ষ্মীট্যাঁরা। কত কত যুবক বা পুরুষ যে অমন তাকানোয় ঘায়েল হয়েছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন একটি নারীর অক্ষিশরে বিদ্ধ হয়েছে তিলক....পুরো ঘটনাটি বছর বিশেক আগেকার ...।
তিলক, মানে, তিলক চক্রবর্তী। ওদের সুবিশাল যৌথ পরিবার। চক্রবর্তী বাড়ি বললেই বিকাশপুর শহরের বাবুপাড়ার যে কেউ দেখিয়ে দেবে ওদের বাড়ি। বাড়ি বললে অবশ্য অনেকখানি কম বলা হয়। খান ত্রিশেক ঘর তো নয়, যেন গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি। বিকাশপুর শহরটি দুইভাগে বিভক্ত। আদি ও নব্য। শহরের মাঝখান দিয়ে গেছে যে মিটারগেজ রেললাইন, তার উত্তরের ভূমি হল আদি বিকাশপুর। দক্ষিণের ভূমি হল নতুন বিকাশপুর। ইংরেজ আমলে আদি বা নব্য বলে কোনো বিভাজন ছিল না। উত্তরের অংশেই বসতি গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ অংশে ছিল বনজঙ্গল আর জলাভূমি। বসতি স্থাপনের জন্য দক্ষিণ একপ্রকার ব্রাত্য-ই ছিল। বিগত কয়েকদশকে ধীরেধীরে দক্ষিণ আধুনিক হয়েছে। চাকচিক্য এবং জৌলুশে উত্তরকে টেক্কা দিচ্ছে। তা যতই দিক, উত্তরের বনেদীয়ানা অর্জন করতে দক্ষিণের আরও অনেক বছর যে লেগে যাবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই পাড়ায়, চক্রবর্তী পরিবারের গোটা তিরিশ ঘর গলির সরু রাস্তার দুইধারে গা ঘেঁষা-ঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। সবারই হাঁড়ি আলাদা। তবে, বছরে একবার এরা সবাই একত্রে খাওয়াদাওয়া করে-- শতাধিক বছরের পুরোনো পারিবারিক দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে। একেক বছরে এক-একটি পরিবারের উপর পূজার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। বাকি শরিকেরা যৌথভাবে নিয়মনিষ্ঠার সাথে সুবিশাল কর্মযজ্ঞে হাত লাগায়।
পুজোর ক'দিন তিলক সাদা ধুতি পরে। গা'য় সাদা আদ্দির ফতুয়া বা স্যান্ডোগেঞ্জি। ঘামে জবজব করতে থাকা ফতুয়া বা গেঞ্জির ভিতর পৈতেটি স্পষ্ট ফুটে ওঠে। প্রায় সমস্তদিন মন্ডপের একধারে টুলের উপর বসে থাকে। কিছুক্ষণ বাদে-বাদেই তাঁতীর চাপানউতোর করবার মতোন করে দু'হাতে পৈতের দড়ি টেনে পিঠ চুলকায়। পারিবারিক পুজোয় মন্ডবের খুঁটিনাটি যা কিছু, সেসব তদারকির ভার থাকে ওর উপর। সেজন্যই হয়ত শরৎকালেও এত ঘামতে থাকে! পাড়া-প্রতিবেশীরা চক্রবর্তী বাড়ির পুজোর জন্য সারাবছর ধরে অপেক্ষা করে। চক্রবর্তীদের শরিকী পুজো তো আর যেমন-তেমন করে হয় না। রীতিমত শুদ্ধ-উপাচারে, প্রথাগত নিয়ম-নিষ্ঠা এবং ভক্তি সহকারে হয় বলে, এদের বাড়ির পুজোর কথা বিকাশপুরে বেশ সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। কয়েকবছর আগেও সপ্তমী থেকে নবমী - এই তিনদিন দুপুরবেলায় পাঁঠাবলি হতো। শহরের বাইরে থেকে ব্যক্তিগত মানত রক্ষার্থে অনেকে বলির পাঁঠা নিয়ে আসত এদের মন্ডপে। বলির সময় রীতিমত ভিড় জমে যেত। কয়েকটা পাঁঠাকে হাড়িকাঠের অদূরেই বেঁধে রাখা হতো। তুমুল ঢাকের বাদ্যি আর মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে এই পরিবারের একজন মধ্যবয়সী শক্ত-সমর্থ পুরুষ বলিপর্ব সমাধা করতো। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষটি ঢুলুঢুলু চোখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আচার-নিয়ম ঠিকমত হচ্ছে কি না সেদিকে নজর রাখতেন। খানিক বাদে বাদেই ধুতির খুঁট থেকে নস্যের ডিব্বা বার করে নস্যি টানতেন। বেশ কয়েকবছর হ'ল এরা বলিপ্রথা তুলে দিয়েছে। পাঁঠার বদলে পুজোয় প্রতিদিন একটি করে চালকুমড়ো বলি দিয়ে মায়ের চরণে উৎসর্গ করা হয়।
এই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটির এগারো ভাই এবং ছয় বোন। এদেরই সর্বকনিষ্ঠ হল তিলক। বড়দা'র সাথে ওর বয়েসের পার্থক্য কমপক্ষে ত্রিশ বছর। আগেকারদিনে বেশিরভাগ ধনাঢ্য বাড়িতে এমন চিত্র আকছার দেখা যেত। সে যাহোক, জন্মের পরে পরেই পোলিও আক্রান্ত হওয়ায় ছোটো থেকেই তিলকের ডান পা সরু এবং অন্য পায়ের তুলনায় সামান্য খাটো। অল্পবয়েসেই পিতৃহীন, তাই, বড়দা-ই ওর অভিভাবক। ওর পুঁথিগত বিদ্যার দৌড় ক্লাস ফোর অবধি। খুঁড়িয়ে চলতে হয় বলে জীবনের বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে এর বেশি পড়াশোনা করবার সৌভাগ্য ওর হয়নি। তবে, বড়দার আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে কখনই ওর মনে হয়নি যে ও পিতৃহীন। কালেকালে যৌবন এসেছে ওর জীবনে। যৌবন পেরিয়েও গেছে। এখন ও চল্লিশ পার করেছে। পা'য় খাটো এবং পরনির্ভরশীল বলে ওর বিয়ে-থা'র কথা চক্রবর্তী পরিবারে কেউ কখনও ভাবেনি। ও নিজে যে ভাবেনি তা নয়, কৈশোর থেকে অদ্যাবধি বিবাহ-বিষয়ে অনেক আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখেছে। সেসব কথা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি লজ্জায়। সম্প্রতি তিলক প্রেমে পড়েছে। ভীষণভাবেই পড়েছে। এককথায় যাকে বলা যায় প্রেমে নিমজ্জিত।
তিলক এখন সারাদিন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। মোহনবাগান ক্লাবের অন্ধভক্ত তিলক-এর এই ঘোর এখন এমন পর্যায়ে, যে, মোহনবাগান হেরে গেলেও ও এখন কাঁদছে না। ওর প্রাণাধিক প্রিয় 'মারফি রেডিও'-তে ধুলোর আস্তরণ জমেছে। তিলক এখন রেডিওর পরিবর্তে ক্ষণেক্ষণেই পোস্টকার্ডগুলোকে সোঁদা গন্ধওয়ালা তোষকের নিচ থেকে বের করে দেখে। হাত বুলায়। বিড়বিড় করে কীসব যেন বলে। হলদে বর্ণের বহুবছরের পুরোনো 'খেলার আসর' পত্রিকার ভিতর সযত্নে লুকিয়ে রাখা এই পোস্টকার্ডগুলো দিনে-রাতে কতবার যে পড়ে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রেমিকা নিজ হাতে ওকে লিখেছে তার ভালোলাগার কথা। ঘুরিয়েফিরিয়ে প্রেমিকার ছবিগুলো দেখে। অল্পসময়েই বেশ কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে ওর প্রেমিকা। সব ছবির একপিঠে প্রেমিকার ছবি, আর অন্যপিঠে ওর উদ্দেশে প্রেমিকার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। মূল বক্তব্য ঘুরেফিরে এই, যে, মেয়েটি তিলককে বিয়ে করতে আগ্রহী। তিলকের মনোজগতে বিরাজমান সবুজ মাঠটায় এখন মোহনবাগান ক্লাবের পরিবর্তে খেলা করছে ওর প্রেমিকার ছবি আর পোস্টকার্ডের ওই কথাগুলো।
পাড়ারই নন্তু'র সাথে এখন তিলকের খুব ভাব জমেছে। দিনের একটা বড় সময় নন্তুর সাথে শলাপরামর্শ করেই কেটে যায়। ওর কাঠের ঘরটায় নন্তু সারাদিনে বেশ কয়েকবার আসে। দু'জনেই ফিসফিস করে কথা বলে। বড়বৌদি প্রথম-প্রথম ব্যাপারটাকে অগ্রাহ্য করেছিল। ক্রমশ বড়বৌদির মনে একটা খটকা জাগল। কী এমন ব্যাপার যে, সারাদিন তিলক ঠাকুরপো নন্তুর সাথে এত ফুসুরফাসুর করে! তাছাড়াও এক-দুইদিন তিনি ঠাকুরপোকে নন্তুর হাতে টাকা গুঁজে দিতে দেখেছেন। পুজো এসে যাওয়ায় বড়বৌদি তার মনের সব খটকা ও সন্দেহকে আপাতত সরিয়ে রেখে পরিবারের সর্ববৃহৎ কর্মযজ্ঞ নিয়ে অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুজো চলে গেলে বিষয়টা তিনি তার স্বামী, অর্থাৎ, তিলক-এর বড়দা'র কানে তুলবেন বলে মনস্থ করলেন।
দশমীর সকাল। চক্রবর্তী বাড়ির বড়রা খুব ভোরে উঠেছেন। নবমীর রাতে কারোরই ভালো করে ঘুম হয়নি। ভালোয় ভালোয় এবং নির্বিঘ্নেই কেটেছে পুজোর ক'দিন। প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল এই তিনদিন। তবে, একটা ব্যাপার কারুর নজর এড়ায়নি, তা হল, তিলক কেমন যেন ঝিম মেরে গেছে। বাড়ির অনেকেই লক্ষ্য করেছে পুজোর ক'দিন তিলক নিজের কর্তব্য-কর্মে বেশ খানিকটা অগোছালো ছিল। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন হবে। চক্রবর্তীদের সুবৃহৎ পরিবারের প্রত্যেক ব্যক্তিকে আজকের দায়-দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ছোটোদেরকেও দায়িত্বের বাইরে রাখা হয়নি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিলক একবারও মন্ডপে আসেনি। দুপুরের খিচুড়ি পর্যন্ত খায়নি। ডাক পাঠানো হয়েছে, তবুও খেতে আসেনি। যাকে দিয়ে ডাক পাঠানো হয়েছিল, সে ফিরে এসে জানিয়েছিল যে, তিলক কাকু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। এটা শুনে হাতের কাজ ফেলে বড় বৌদি খানিকটা হন্তদন্ত হয়ে তিলকের খুপরি ঘরে গেলেন। তিনি দেখলেন তিলক বালিশে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান্নার কারণ কিছুতেই বলছে না। বাড়ির বড়দের কাছে খবর গেল। বড়দা এবং অন্য দাদা'রা এসে প্রথমে লঘুস্বরে জানতে চাইলেন। ফল না পাওয়ায় এরপর তাদের কন্ঠস্বর ক্রমশ চড়া হল। বেশ কিছুক্ষণের তীব্র জেরায় অবশেষে তিলক মুখ খুলল। ও জানালো যে, মেয়েটি নন্তুর হাতে ষষ্ঠীর দিন একটি পোস্টকার্ড পাঠিয়েছে, সেখানে স্পষ্ট লিখেছে, তিলককে বিয়ে করা সম্ভব নয়। একথা শুনে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল! বড়দা পোস্টকার্ডগুলো দেখতে চাইলেন। প্রথমেই অন্য দাদারা পোস্টকার্ডগুলো হাতে নিয়ে ভালো করে দেখছে, সবার কপাল কুঁচকে গেছে...হঠাৎ সবাই সমস্বরে হো-হো করে হেসে উঠল, তারপর বলল, এগুলো হিন্দি সিনেমার এক নায়িকার ছবি দেওয়া পোস্টকার্ড, যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। পিছন পিঠের ফাঁকা জায়গায় বাংলা হস্তাক্ষরে প্রেমপত্রের মতো করে লেখা। অসম্মতি জানানো পোস্টকার্ডটিও তাই।
... রাশভারী বড়দাও হেসে উঠলেন এবং বললেন: "সাধে কী আর তোকে গর্ধভ বলি রে আহাম্মক! বয়েস বাড়লেও তোর বুদ্ধি এখনও হাঁটুর নিচেই থেকে গেল!"
যথাসময়েই প্রতিমা বিসর্জন হ'ল। চক্রবর্তী বাড়ির রীতিমাফিক দুর্গাকে উপুড় করে জলে বিসর্জন দেওয়া হল। বিষাদভারে জর্জরিত মন ও ক্লান্ত শরীর টেনেটেনে একে একে সবাই বাড়ি ফিরে এল। মন্ডপ খাঁ-খাঁ করছে। কারো চোখে জল, কেউ বা চৈত্রের বাতাসের মতো উদাস ও বিষণ্ণ। বাড়ির ছোটোদের চোখমুখেও কী নেই, কী নেই-- এমন একটা কষ্টের ছবি ফুটে উঠেছে। শূন্য মন্ডপের সামনে বড়-ছোটো সবাই জোড়হাতে হাঁটু গেড়ে বসে শান্তিজল মাথায় নিচ্ছে। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অদৃশ্য মা-র উদ্দেশে প্রণাম করছে। প্রতিমার বেদীর সামনে একটি প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। পারিবারিক এই ভিড় থেকে একটু দূরে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তিলক, শূন্য মন্ডপের প্রদীপ শিখার দিকে অপলক চেয়ে আছে...পরিবারের দু-একজন মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসছে। এদিকে, ওর সাদা পাজামার সামনে-পিছনে লেগে আছে ভাসান-চরের আলতা মাখা জ্যাবজ্যাবে বালি...ভেজা ফতুয়া থেকে টুপটুপ করে জল ঝরছে অবিরত....
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴