গরল/আশিস চক্রবর্তী
গরল
আশিস চক্রবর্তী
ভৈরবী নদীর ধারে বিশু হালদারের সাত পুরুষের ভিটে। আর তার এক পাশে খড়ের ছাউনি তোলা এক টুকরো মাটির ঘর। জল ছুঁই ছুঁই উঠোনে ওর পূর্বপুরুষরা কাদা মাটি মেখে নদীর গর্ভ থেকে মাছ তুলে, হাটে বাজারে বিক্রি করে জীবন অতিবাহিত করত। এখন বংশানুক্রমে সে নদী এসে গিয়েছে বিশুর হাতে। ওই নদী যেন ওদের জমিদারীর অংশ। বিশুর এখনও মনে আছে তার বাপ মড়ার আগে বিশুর হাতে হাত রেখে বলেছিল, "নদীর ওই ঘোলা জলে মাছ ধরিস বিশু! শহর মুখো হোসনা! জেনে রাখ! ওপারের সবেতেই বিষ! এই ভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকিস। মনে রাখিস, ওই ঘোলা জলই আমাদের দেবতা। ভক্তিভরে ওই জলের স্রোতে কান পাতলে অনেক পুরোনো ইতিহাস শুনতে পাবি!"
বাপের কাছ থেকে নিজের জমিদারীর অংশ বুঝে নিয়ে বিশু মাথা নেড়ে ছিল সেদিন। তখন ছিল সে ছেলে মানুষ। আজ কাঠখোট্টা শক্ত পুরুষ মানুষ। মনের ভেতর শখ আহ্লাদ ঠাসা। রোজ ঘাড় উঁচু করে নদীর ওপারে ঝকঝকে শহর দেখে বিশু। ভাবে, স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে তাহলে ওপারেই। এপারে সন্ধে নামলেই কেরোসিনের বাতি, শেয়ালের ডাক, নিশাচর এর উড়ন্ত ডানার ঝটপটানি, পায়ের কাছে সরীসৃপের ঘোরাফেরা আর জলের কুলকুল বয়ে যাওয়া শব্দ ছাড়া, কিছু নেই! নদীতে আর সেরকম মাছ ওঠে না। ওই দিয়ে মোটা ভাত কোনো রকমে জুটলেও, সুখ জোটে না। এভাবে কী জীবন চলে?
পরের বছর বিশু রাঙা বউ এনে ঘরে তুললো। পাড়ার বুড়ো মুংলা বলল, "কচি লাউ ডগার মতো বউ এনেছিস বিশু। এবার সংসারটা একটু মেরামত কর। এবার তোর দুটো পেট! জাল হাতে নদীতে ডিঙি বেয়ে চল বেশি বেশি! দেখবি সংসারও বইবে ঠিক বর্ষার নদীর মতো।"
বুড়ো মুংলার কথা বিশুর কানেও ঢোকে না।ওর সুখ কুড়োনোর স্বপ্নের বাতাসের ধাক্কায় বুড়ো মুংলার মুখের ভাষা ঠোক্কর খেয়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়। প্রায় দিনই বিশু ঘোলা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, ওপারে গিয়ে পাকা ঘরে সংসার পাতবার স্বপ্ন দেখে! আর নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রতি রাতে কুঁড়ে ঘরের চাল ফাঁক করে চাঁদের আলো নতুন বউ এর মুখে পড়লে হীরার মতো চক চক করে ওর যৌবন। তার পাশাপাশি ফুটে ওঠে ওর দারিদ্রতার চিহ্নও। বিশুর এসব আফসোস ও স্বকল্পনার গতিবেগের সাথে পাল্লা দিয়ে চলল সময়।
এক সময় নদীর ওপারে খুললো প্লাস্টিকের কারখানা। পাড়ার ছেলে ছোকরারা যে যেমন পেরেছে কাজে ঢুকেছে। অনেক ভেবে চিন্তে নদীর এপারের ঝুপড়ি ছেড়ে লোটা কম্বল গুটিয়ে, বউ -এর হাত ধরে, বিশু ছুটল ওপারের স্বপ্নের নগরী। যেতে যেতে পিছন থেকে শুনেছিল বুড়ো মুংলা বলেছিল, "যাসনে বিশু! ও ডাকে সাড়া দিস নে! ও নিশির ডাক! ফিরে আয়! ফিরে আয় বলছি! নদী বড় কাঁদছে!"
কিন্তু 'কাকস্য পরিবেদনা।' বিশুর সাত পুরুষের ভিটেয় পড়ে রইলো কেবল নতুন বউ -এর প্রথম আগমনের আলতা মাখা পায়ের ছাপ।
ওপারে ব্যস্ত শহর, আলোর ঝর্ণায় হাসি আর উল্লাস নিয়ে শুরু হল বিশুর নতুন জীবন। পীড়াপীড়ি করে জুটে গেল প্লাস্টিক কারখানায় চাকরি। আর কারখানার লাগোয়া ভাড়ার পাকা ঘর। এবারে নিজেকে বেশ শক্তপোক্ত মনে হল ওর। বুক ভরে স্বাস নিতে পারছে যেন সে। এতকাল যেন বাতাস থেকে কেবল একবুক দুঃখ দুর্দশাই টেনে নিয়ে বেঁচে ছিল ও। এখন উপলব্ধি করতে পারছে সত্যিকারের বাঁচার অর্থ। প্রতি রাতেই ওর নতুন ভাড়ার ঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে, বিশু নদীর ওপারে তার পরিত্যক্ত সাত পুরুষের ভিটের দিকে চেয়ে দেখে। ওর নজরে পড়ে কেবল অন্ধকারের স্তুপ। কানে আসে ক্ষুধার্ত শেয়াল কুকুরের সমবেত চিৎকার। যেন এক শ্মশানপুরী। এতকাল কী বোকামীটাই না সে করেছে। অনেক আগেই উঠে আসা উচিত ছিল সেই নরকপুরী থেকে। বর্তমান সুখের কথা চিন্তা করে এক গাল হেসে সে ঘুমিয়ে পড়ে। কারখানায় সকাল হতেই কাজ চলে। দূষিত পদার্থ নালী পথে গিয়ে মেশে ভৈরবী নদীর বুকে। ক্রমে ক্রমে কালো হয়ে উঠছে নদীর গর্ভ।
একদিন গভীর রাতে কোলাহলে ঘুম ভাঙে দুজনের। বিশু বিপদের আশঙ্কা অনুভব করে বউকে বলল, "যাই! দেখে আসি! কী হল? এত চেঁচামেচি কীসের? তুমি বেরিও না এক পা। দোর এঁটে শুয়ে থাকো। এখন অনেক রাত। তোমার বাইরে বেড়ানো উচিত নয়! আমি এক্ষুনি ফিরে আসব!"
কথা শেষ করে বিশু ঘরের দরজা খুলে ছুট দেয় বাইরে। তড়িঘড়ি বিশুর সুন্দরী বউ ঘরের ভেতর থেকে দরজা এঁটে শুয়ে পড়ল। রাস্তায় নেমে বিশু বিস্ফারিত চোখ নিয়ে চমকে ওঠে। সে দেখে কারখানা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সকলেই জল ঢেলে চলেছে সাধ্যমত। বিশুও যোগ দেয় আগুন নেভানোর কাজে। কিন্তু এ যেন অভিশাপের আগুন! কিছুতেই নেভবার নয়! যেন বৃথা চেষ্ট করে চলেছে সকলে! অনেক পরে দমকল আসে। কিন্তু সকাল হতে চললেও, উর্ধ্বমুখী লেলিহান বহ্নিশিখার অহংকার বিন্দুমাত্র কমে না। সমস্ত কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে যায়! তার সাথে পুড়ে ছাই হল বিশুর রঙিন স্বপ্ন। ওর মাথায় যেন মেঘসুদ্ধ আকাশ ভেঙে পড়ল। ওর চোখের জল শুকিয়ে আসে আগুনের তাপে। এরপর ভাঙা মন, অশ্রুর শুকিয়ে আসা রেখা আর অবসন্ন শরীর নিয়ে ঘরের সামনে এসে আবারও চমকে ওঠে বিশু। কখন চুপিসারে কাল নাগিনীর মতো আগুনের লকলকে শিখা ছুঁয়ে গেছে তার ঘরের দোর। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাজারো চিৎকার করে কোনো সাড়া শব্দ আসে না ভেতর থেকে। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রনায়, কম্পমান শরীর নিয়ে দরজায় আঘাতের পর আঘাত হেনে যায় বিশু। বন্ধ জানলার ফাঁক ফোকর দিয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে স্বগর্বে। বিশু নিজের সর্ব শক্তি নিংড়ে চেষ্টা করে চলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার। পরক্ষনেই ও সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে, দরজা ভেঙে আছড়ে পড়ে উত্তপ্ত ঘরের মেঝেতে। তারপর বিস্ফারিত চোখ নিয়ে ও দেখে, ওর পাশে পড়ে খাবি খাচ্ছে তার আদরের বউ। হেজে যাওয়া কচি পাতার মতো বৌটা। আকাশের দিকে হা করে সমস্ত হাওয়া নিজের শরীরের ভেতরে নেয়ার চেষ্টা করে চলেছে ক্রমশ। তারপর আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় শেষ চেষ্টাটাও। এরপর পাগলের মতো, স্ত্রীর দগ্ধ শরীরটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে গগনভেদী চিৎকারে ফেটে পড়ে বিশু।
হাজারো হাঙ্গামার পর পুলিশ আসে। তদন্তের খাতিরে স্ত্রীর মৃতদেহ ছেড়ে উঠে যেতে হয় বিশুকে। বেলা গড়িয়ে গেলে চাবি দেয়া পুতুলের মত নিস্তেজ ভাবে নিজের সাত পুরুষের সেই ভিটেই পুনরায় ফিরে আসে বিশু। সেখানে এসে, ও আশ্চর্য হয়ে দেখে ভৈরবী নদীর কালো বর্জ্য পদার্থ মিশ্রিত পঙ্কিল জল থেকে পাড়ে উঠে এসে হাজারো মাছ খাবি খাচ্ছে। সেই পুরোনো অদ্ভুত কায়দার খাবি। পৃথিবীর সমস্ত বায়ুমন্ডল যেন নিজের শরীরে টেনে নিতে চাইছে মাছে রা। সেই একই রকম খাবি। একটু আগেই যা বিশু তার বউ এর পুড়ে যাওয়া মুখটায় লক্ষ্য করেছিল। কি ভয়ঙ্কর, বীভৎস, কুৎসিত সে দৃশ্য !
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴