আগমনী/শ্রাবণী সেন
আগমনী
শ্রাবণী সেন
শরতের সোনাঝরা সকাল, বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন আনন্দমোহন! আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ সোনালি ধানে ভরপুর। সকালের মিঠে হাওয়ায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে শস্যভারানত সবুজ সজীব ধানের ওপর!
পুব আকাশে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হচ্ছেন সহস্রকিরণ সূর্যদেব! দুচোখ ভরে দেখে নিচ্ছেন আনন্দমোহন! প্রথম সূর্যের আলো যেন স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে আনন্দমোহনের চুলে, চোখের পাতায়, মুখে, গালে!
রক্তাভ তামার ঘটিতে রক্তজবা ও রক্তচন্দন মিশ্রিত জলে সূর্যপ্রণাম সমাপন করলেন আনন্দ। বারান্দার গাছগুলিতে জল দিয়ে শুকনো পাতাফুল ফেলে দিতে দিতে আনন্দমোহন সূর্যদেবের স্তবগুলি অনুচ্চ গম্ভীর স্বরে আবৃত্তি করে চলেছেন। তাঁর নিজের হাতের বাগান থেকে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। শিউলিগন্ধ খুব মন কেমন করা, শৈশবের কাছাকাছি, মায়ের আঁচলের গন্ধ যেন! যে মা শারদীয়া জগজ্জননীও যেমন নিজের মা-ও তেমনই।
উত্তরের বারান্দায় এসে সামনে তাকালেন আনন্দ। আজ পঞ্চমী। নীচে দুর্গাদালানে মা দুর্গার প্রতিমা এখনো সমাপ্ত হয়নি, আজ সারাদিন ধরে জগজীবন আর তার সঙ্গী সব যথাযথ করেই ফেলবে। একে একে সবাই এসে পড়বে আজ বাড়িতে, তিনছেলে - বৌমারা, নাতি নাতনিসহ, নাত বৌও হয়ে গেছে বৈকি একটি, আসবে তারাও আসবে, সবাই আসবে এবার।
আনন্দমোহন জানিয়ে দিয়েছেন সবাইকে, এবার পুজোয় প্রত্যেককেই আসতে হবে। নব্বই বছর বয়সটা বড় কম নয় তো! কেমন যেন মনেহচ্ছে জীর্ণবস্ত্র ছাড়ার সময় এসে গেছে! অবশ্য যথেষ্ট কর্মক্ষম ও সতেজ আছেন তিনি। তুলনায় নমিতা যেন একটু বেশিই এগিয়ে গেছেন বার্ধক্যের রাজপথে।
পুজোর দালানের দিকে তাকিয়ে আনন্দমোহন কখন যেন শৈশবে পৌঁছে গেছেন। তখন এই নতুনগ্রামে একটিমাত্র পুজো হত, তাও পারিবারিক পুজো, ওপাড়ার রায় বাড়িতে, সবাই বলত উকিলবাড়ির পুজো। ও বাড়ির কর্তারা পাঁচভাইই ছিলেন উকিল। দুর্গা পুজো হত খুবই জমকালো। ও বাড়িতে নিমন্ত্রণও থাকতো আনন্দমোহনদের সপরিবারে, মা যেতেন পুজোর জোগাড়ে হাত লাগাতে, তাও নেহাতই 'সরমা যাওতো আর দুটো দুব্বো ঘাস তুলে আন,' কি 'বেলপাতা বেছে রাখো তো' গোছের কাজ! বিশাল পাখাটা দিয়ে মা দুর্গাকে হাওয়া করা, বা চামর দুলিয়ে বাতাস দেওয়া এগুলি রায়বাড়ির মেয়েবৌদের জন্যই বরাদ্দ থাকতো। মায়ের দিকে তাকালেই আনন্দ বুঝতে পারতো মায়ের খুবই ইচ্ছে করে ওই পাখাটা নাড়িয়ে বা চামর দুলিয়ে মা দুর্গাকে হাওয়া করতে।
রায়বাড়িতে পুজোর জমজমাটে কত কত বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে! সবাই নতুন নতুন জামা পরে। খুশির হাওয়া যেন পুরো বাড়িটায়। মা দুর্গার হাসি হাসি মুখ! ঢাকের বাদ্যি, শাঁখের ধ্বনি! আনন্দ বলত "আমি বড় হয়ে আমাদের ঘরেও এমনই বড় ঠাকুর আনব মা"। মা শুনে ম্লান হাসতেন।
আনন্দর বাবা যে বড় হঠাৎ করেই চলে গেলেন। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সরমা অথৈ জলে পড়লেন। চারপাশে জমিজমা অনেক ওদের, কিন্তু দুই একজন ছাড়া কেউই তো ন্যায্য পাওনাও দিতে চায় না, জমি থাকলেই তো আর হবে না চাষ করবে কে? কায়ক্লেশে দিন কাটত তখন। শোক ভুলে সরমাকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হয়েছিল। আনন্দ গোবিন্দ দুইভাইকেই নিজের বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনার জন্য। দুইমেয়েকে নিয়ে গ্রামেই থাকতেন সরমা। মেয়েরা পাশের গ্রামের স্কুলে পড়ত, পায়ে হেঁটে যাতায়াত, দুমাইল রাস্তা।
আনন্দ বরাবরই ভালো ছাত্র ছিলেন, মামারাও খুবই নজর রাখতেন ওর ওপর, স্কুল পাশ করে মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ও অর্থ সামর্থ্য সব নিয়েই তিন মামা পাশে ছিলেন। মামাদের অবদান কোনোদিনই আনন্দ ভোলেননি। মামীমারাও যত্ন ও স্নেহে ভরিয়ে দিয়েছেন। পাস করে চাকরি পেয়ে বড়মামার শ্বশুর বাড়ির দিকের সম্পর্কে বিয়ে হল আনন্দর নমিতার সাথে।
গোবিন্দও গ্র্যাজুয়েশন করে বিটি পাশ করলেন। ততদিনে গ্রামে হাই স্কুল হয়েছে গোবিন্দ সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করলেন।
এবার শুধুই এগিয়ে যাবার গল্প তাঁদের। টাকা পয়সা, লোকবল সব দিয়ে দুই ভাই পুরোনো সব জমি উদ্ধার করলেন। নতুন জমিও কিনলেন গ্রামে।
আনন্দ জেলা শহরগুলিতে এবং পরে পরে কলকাতার কাছেই পোস্টিং পেলেন। নিয়মিত গ্রামে যাতায়াত করেছেন সস্ত্রীক এবং পরে, তিনছেলে নিয়ে। যথেষ্ট ভালো ঘরে, পরিবারে দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, ছোট বোনটি তো প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষিকাও ছিল ওর শ্বশুর বাড়ির গ্রামে। ভাইয়েরও বিয়ে হল পাশের গ্রামের বনেদি পরিবারের অতি সুশ্রী এবং সহৃদয়া মেয়ের সাথে। ওদের দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে। মেয়েটি সবারই নয়নমণি।
মোটামুটি দুই ভাই যখন স্বচ্ছলতার মুখ দেখলেন তখন তাঁদের মনের সুপ্ত বাসনা আবার জেগে উঠল। দুর্গা পুজো আনতে হবে বাড়িতে। বাড়িও এখন বিশাল বড়, তিনতলা বাড়ি। গোবিন্দ, মা এবং দুই বৌকে আনন্দ ডাকলেন আলোচনার জন্য। সবাই সহমত হলেন পুজো হবে। ছেলে মেয়েরা সব পড়াশোনা করছে, এরপর চাকরি করবে। অন্তত পুজোর সময় তো একসাথে থাকবে সবাই, এই বাড়ি আনন্দে ভরে উঠবে তখন।
সেই শুরু। তারপর তো কত বছর কেটে গেছে। পুজো চলছে ভক্তি ও নিষ্ঠা নিয়ে। মা আজ আর নেই, গরদের কাপড় পরে মা বড় পাখায় মা দুর্গাকে হাওয়া করছেন, ছবিটা প্রাণভরে দেখেছে আনন্দ।
আনন্দর ছেলেরা ও গোবিন্দর ছেলে মেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত এখন। বোনেদেরও ছেলে মেয়েরাও সবাই সুশিক্ষিত এবং স্বচ্ছল।
এখন তো তাঁর নাতি নাতনিরাও চাকরি করছে, পড়াশোনা করছে। বড় নাতির বিয়েও হয়েছে সম্প্রতি। আজ সবাই এসে যাবে।
রাত কাটে। ঘর পরিপূর্ণ করে সবাই উপস্থিত, আনন্দর হৃদয়ও পূর্ণ! আজ ষষ্ঠী, সন্ধ্যা বেলায় দেবীর বোধন। বেলতলায় ভাইঝি আর বৌমারা আলো ঝলমলে মুখে পুরোহিতের হাতের কাছে উপচার সাজিয়ে দিচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে গল্পও করছে একই সাথে।
নাতি নাতনিরা আর নাত বৌ একসাথে দঙ্গল বেঁধে আছে, যেখানেই যাচ্ছে সবাই একসাথে। হুড়োহুড়ি করে শাঁখ ঘন্টা বাজাচ্ছে, ঢাকও বাজাচ্ছে সবাই পালা করে। নমিতা, ছোট বৌ আর বোনেরা ঠাকুর দালানে বসে পুজোর জোগাড় এগিয়ে রাখছে, কাল সপ্তমী কাল সকালেই কলাবৌ স্নান, ঘট স্থাপনা করে পুজো আরম্ভ হবে।
আনন্দর অন্যমনষ্ক কানে ঠাকুরঘরের টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে বড় বোন কল্যাণী বলছে - "ও ছোট বৌদি, আমাদের সতেরোটা নৈবেদ্য তো! আরও দুটো থালা বার করাওনি?" শুনতে পেলেন নমিতা বলছে -"ছোট, বড় বৌমাকে বলে দিস তো লালপেড়ে শাড়ি পরে যেন কাল, লক্ষ্মী আনার সময়!" ছোটবোন বলছে- "বৌদি চামর, পাখা সব গুছিয়ে রাখি এই ডালাতে?"
রান্না চালায় লুচি ভাজা হচ্ছে। আজ ষষ্ঠী ভাত হবে না।
বড় বৌমার গলা পেলেন আনন্দ - " ঠাকুর মশাই, ছোলার ডালে নারকোল ভাজা দিয়েছেন তো? ছোড়দাভাই ভালোবাসে।" অন্য বৌমারা হেসে উঠল শব্দ করে।
ভাইঝি সুনন্দা সবাইকে বোধনের প্রসাদ দিচ্ছে, আনন্দকে প্রসাদ দিয়ে একটুক্ষণ গল্প করে গেল। ছোট ভাই গোবিন্দ ভগ্নিপতিদের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে। ছেলেরা আর সুনন্দার বর মলয়ও জমে গেছে আড্ডায়। সবার হাতে চায়ের কাপ!নাতি নাতনি, নাতবৌ সব ছাতে গেছে, ওদের নিজস্ব জমায়েতে।
ডেকোরেটার্সের ছেলেরা আলোর মালায় সাজিয়ে তুলছে গোটা বাড়ি। পরিপূর্ণ মন নিয়ে আনন্দ আবার তা়ঁর দোতলার বারান্দা বাগানে এলেন। মৃদুস্বরে গান বাজছে -
"জাগো তুমি জাগো, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী..."
সদ্যফোটা শিউলির গন্ধ এল এক ঝলক! আনন্দর মনেহল মা এসে দাঁড়িয়েছেন ওর পাশে।
কাল সপ্তমী। মায়ের পুজো শুরু।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴