পৃষ্ঠা বন্ধ করলেন ডুয়ার্সের অভিধান/অমিত কুমার দে
পৃষ্ঠা বন্ধ করলেন ডুয়ার্সের অভিধান
অমিত কুমার দে
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
এ লেখা যখন লিখছি, তিনি তখন বরফের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। খুব শীতকাতুরে ছিলেন। তবু আজ রাত তিনি তুষের ওপর বিছানো খন্ড খন্ড বরফের ওপর শুয়ে থাকবেন। একটা কফিনে আজ রাত ঠান্ডায় হিম হয়ে শুয়ে থাকবে ডুয়ার্সের অভিধান। ছোট মেয়ে কাল এসে মুখাগ্নি করবে, ভেজা চোখে সে এখন কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে।
আমি 'মেসোমশাই' বলে ডাকতাম। কিন্তু মনে মনে কতকাল ধরে "বাবা" বলেই ডেকেছি। বাইশের নভেম্বরের প্রথম দিন অপরাহ্নে চিরদিনের মতো চোখ বুঁজলেন ব্রজগোপাল ঘোষ। গয়েরকাটা চা বাগানে তাঁর কোয়ার্টারে। যার দরজায় সাঁটা নেমপ্লেট B. G. Ghosh।
বারান্দাটা বড্ড মোহময় ছিল। প্রায় আড়াই দশক সেই বারান্দায় তাঁর মুখোমুখি বসেছি। ঘন্টার পর ঘন্টা। বাগানের হাওয়া আমাদের দুজনের শরীর ছুঁয়ে যেত। সামনের ৩১ নং জাতীয় সড়ক দিয়ে শয়ে শয়ে ছোট বড় গাড়ি চলে যেত। মেসোমশাই আমায় বলে যেতেন চা বাগিচার গল্প। ইউরোপীয়ান ম্যানেজারদের রকমারি কাহিনি, তাসাটি বাগানের ভোর থেকে রাত - যেখানে তাঁর জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান দিনগুলো কেটেছে, বাগানিয়া হাটের গল্প, বাগানের জমজমাট খেলা আর মেলার কথা। বলতেন চা বাগানের হাসপাতালের গল্প। এই বারান্দায় বসেই শুনেছি তাসাটির কোয়ার্টারে আসা শোলমারীর সাধুর গল্প। তিনি বলে গেছেন গরুর গাড়িতে চড়ে তাসাটি থেকে ফালাকাটায় পরীক্ষা দিতে যাবার রোমহর্ষক গল্প, যে পথে বাঘ ঘুরে বেড়াত। বাঘ হাতির কত কত গল্প শুনতে শুনতে অতীতের ডুয়ার্সে আমিও পৌঁছে গেছি।
কতবার ভেবেছি তাঁকে নিয়ে, তাঁর এত সব গল্প জড়িয়ে একটা বড় উপন্যাস লিখব। কিন্তু নিজে চা বাগানের মানুষ না হওয়ায় সাহস পাইনি! বারবার ভেবেছি একজন বাগানিয়াকে দিয়েই একদিন লিখিয়ে নেব আমার এই কাঙ্ক্ষিত উপন্যাসটি। অবশেষে যোগ্য হাতে তা করাতে পারলাম। মেসোমশাইয়ের জীবনকে কেন্দ্রে রেখে নয়া সাইলি বাগানের সুকান্ত নাহা-কে দিয়ে আমাদের 'সহজ উঠোনে' লিখিয়ে নিলাম "চা-ডুবুরি"। আজ শান্তি পাচ্ছি এটা ভেবে যে, প্রান্তবেলায় মানুষটি বড় আনন্দ পেয়েছেন। নিজে দেখতে পারতেন না পড়তে পারতেন না, মুঠোফোনে তাঁকে পড়ে শোনাতেন স্নেহের শ্যালিকা নমিতা সেন (অর্ণব সেনের সহধর্মিনী), প্রিয়জন সুছন্দা লাহিড়ী, কন্যা তুলতুল।
অনন্ত শোককে এভাবে কোথায় লুকিয়ে রেখে শান্ত সমাহিত থাকা যায়, বারবার সামনে বসে অবাক হয়ে ভাবতাম। বড় ছেলে স্কুলের সিঁড়ি থেকে পড়ে প্রাণ হারায়, তরতাজা ছোট ছেলেটিও আকস্মিক চলে যায়, বড় কন্যা বুবু - যে তাঁর আশ্রয় ছিল সেও হুট করে না ফেরার দেশে, মাসিমা ক্যান্সারে চলে গেলেন। তাঁর যে কোয়ার্টারটা প্রাণোচ্ছ্বল ছিল, তা কখন যেন নিষ্প্রদীপ হয়ে গেছিল। তবু তিনি শান্ত। শুধু একদিন তাঁর চোখে ক্ষণিক জল দেখেছিলাম আমি। মাত্র দু এক মাস আগে। কিন্তু তাও নয় নিপুণভাবে সামলে নিলেন!
আমাকে তিনি নাথুয়া থেকে আবিষ্কার করেছিলেন। সদ্য শিক্ষক হয়ে ডুয়ার্সে এসেছি তখন। তারপর ভালোবাসায় স্নেহে বেঁধে ফেললেন। আমার প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়তেন। তাঁর পায়ের কাছে বসে ডুয়ার্সের পাঠ নিয়েছি তিন দশক। আমার সম্পাদিত 'চিকরাশি' তাঁর প্রশ্রয় পেয়েছে জন্মলগ্ন থেকে। তাঁর আর বুবুর উৎসাহে পুজোয় বের হত "মাতল রে ভুবন", আমার কবিতাই ছিল তাঁর প্রথম কবিতা। মহালয়ার অনেক আগেই আমার বাড়িতে মেসোমশাই চলে আসতেন, বুবু আসত। বাগানের আরো অনেকে। কচিকাঁচাদের লেখা আমি ঠিকঠাক করে দিতাম আনন্দে। এবং আমার জন্য আসত গয়েরকাটা বাগানের টাটকা চাপাতা।
চা বাগানের কর্মচারী সংগঠন থেকে ব্রজগোপাল ঘোষের সম্পাদনায় বেরিয়েছিল অসামান্য স্মারক পত্রিকা "সংহতি"র কয়েকটি সংখ্যা। চা বাগানের ওপর অনবদ্য কাজ। পুনর্মুদ্রণ প্রয়োজন। তিনি প্রকাশ করেছিলেন "মন্দার" নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও। কোনোদিন নিজেকে প্রচারের আলোয় আনেননি। বই মাত্র একটি, অর্ণব সেন-এর সঙ্গে যৌথভাবে। অথচ তিনিই ছিলেন যোগ্যতম মানুষ - যিনি অনায়াসে লিখে ফেলতে পারতেন ডুয়ার্সের চা বাগিচার প্রামাণ্য ইতিহাস।
জীবনের প্রায় সব কথাই আমায় বলেছেন। কেন জানি না, আমায় বলে শান্তি পেতেন। কোনোদিন তাঁর মুখে কারোর প্রতি কোনো অভিযোগ শুনিনি, অথচ করবার কতটা ছিল আমি জানি। প্রান্তবেলার সঙ্গী ছিল রেডিও। মন দিয়ে শুনতেন। দিন ফুরিয়ে আসছে এটা খুব অনুভব করতেন। এই তো মাসখানেক আগে আমায় বললেন - "অমিত আমি চলে যাচ্ছি, তুমি একদিন এসে আমার সংগ্রহের বইগুলো নিয়ে যেও।" নিজে চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ ভারতে যাওয়ায় যাওয়া হয়নি। আমার কাছে শুনতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের "পৃথিবী" কবিতাটি। শোনানো হয়নি। বড্ড আফসোস থেকে গেল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴