সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
02-December,2022 - Friday ✍️ By- অরুণ চক্রবর্তী 2.04K

দেবেশকান্তি চক্রবর্তী : এক ব্যতিক্রমী মননশিল্পী/অরুণ চক্রবর্তী

দেবেশকান্তি চক্রবর্তী : এক ব্যতিক্রমী মননশিল্পী
অরুণ চক্রবর্তী
------------------------------------------------------------------

গত কয়েকদিন ধরে মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত। চোখের সামনে যেন গোটা আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো। ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি এই বেদনার সম্মুখীন হতে হবে। কী লিখবো ভাবতেই মনে হচ্ছে আমারও ভেতর যেন এক গভীর স্তব্ধতা কাজ করছে।
জীবনের সাত দশকের বেশী সময় অতিক্রম করেছি। কিন্তু রায়গঞ্জের সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে যাদের সাথে প্রতিনিয়ত ওঠাবসা, যাদের সাথে আত্মার গভীর সংযোগ, তাদের মধ্যে দেবেশ ছিল এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। ওর সাথে পরিচয় প্রায় ৪৫-৪৬ বছর।খুব কাছ থেকে দেখেছি, বুঝেছি সাধারণের মধ্যে লুকিয়ে আছে অসাধারণত্ব। 
১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে অনার্স গ্র‍্যাজুয়েট হবার পর জীবিকাসূত্রে চলে যাই কলকাতা এ জি বেঙ্গল অফিসে চাকুরী নিয়ে। তখন দেবেশ রায়গঞ্জে বিদ্যাচক্র স্কুলের ছাত্র। চিনতাম না। মাঝে মাঝে বাড়ি এলে শুনতাম একটি তরুণ ছেলে ভালো গল্প লিখছে। ইত্যবসরে আমারও কিছু কবিতা, প্রবন্ধ রায়গঞ্জ এবং কলকাতার কিছু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাসূত্রে জীবিকাক্ষেত্র পরিবর্তন করে ১৯৭৪ সালের মে মাসে আমি ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের শিলিগুড়ি শাখায় যোগদান করি। বাড়ি এলেও চেষ্টা করেছি দেবেশের খোঁজ নিতে। দেখা হয়নি। ও ইত্যবসরে স্কুলের সীমা ছাড়িয়ে রায়গঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়েছে।
সালটা ছিল ১৯৭৬,মাস ডিসেম্বর। তারিখটা মনে নেই। শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ায় যে মেসে থাকতাম সেখানে একদিন সকালে রায়গঞ্জের আশিস চক্রবর্তী (ডাক বিভাগের কর্মী,বর্তমানে শিলিগুড়ির স্থায়ী বাসিন্দা) এক তণকে সাথে নিয়ে আসে এবং আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেটাই দেবেশের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সেই শুরু।
১৯৭৭ সালে আমি কর্মসূত্রে রায়গঞ্জে বদলি হয়ে আসি।দেবেশকে পাই ভাই এবং বন্ধুর মতো।এর মধ্যেই দেবেশের গল্পে মুন্সিয়ানা বুঝতে পারি।ওর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'সানুচর জলৌকা।' সহজ সরল খুব মিশুকে ছেলে।গভীর জ্ঞানপিপাসু আর পরোপকারী।১৯৫৫ সালের ৩রা এপ্রিল জন্ম।দারিদ্র‍্যের সাথে লড়াই করা জীবন।গরীব পরিবারের ছেলে।রায়গঞ্জে উদয়পুরে বাড়ির কাছে ওকে দরজির কাজ করতে দেখেছি। লড়াইকে ভয় পেত না।১৯৭৮ সালের জানুয়ারী মাসে শুরু হয় রায়গঞ্জ থেকে প্রকাশিত 'চয়ন' পত্রিকার যাত্রা। তারপর থেকে আমরণ আমাদের বন্ধু, ভাই, শুভাকাঙ্ক্ষী। 
একজন যুবকের যেটা স্বাভাবিক দেবেশও খুঁজতে থাকে তার জীবিকার পথ। সাথে চলতে থাকে সাহিত্যচর্চাও। আশির দশকে বেঙ্গল লাইব্রেরি এসোসিয়েশনের ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে প্রথমে মালদহ জেলার এক গ্রামীণ পাঠাগারে যোগদান করে।এই ডিপ্লোমা কোর্সে তাকে ভীষণভাবে যোগা্যো সাহায্য করেছিল আশিস চক্রবর্তী  এবং রথীন্দ্র নাথ রায়।মালদহ জেলার সেই গ্রামীণ পাঠাগারে থাকাকালীন সেই অঞ্চলের মানুষদের জীবন জীবিকা নিয়ে বহু বিখ্যাত গল্প লিখেছে। রায়গঞ্জে সময় পেলেই আমি, বন্ধু সৌরেন, প্রয়াত গল্পকার জ্যোতির্ময় দাস (জ্যোতির্ময়দা) চলে যেতাম আশপাশের গ্রামে। সেখানে সবকিছু জানার ব্যাপারে দেবেশের অনুসন্ধিৎসা ছিল অসাধারণ। আমরাও ঋদ্ধ হতাম। মাঝে মাঝে গল্পকার/সম্পাদক কমলেশ গোস্বামীও আমাদের সাথী হতেন।
আসলে জীবনের সাথে জীবনের যোগ না থাকলে মানুষ চেনা যায় না, গল্প বা সৃষ্টিতেও তা প্রতিফলিত হয় না স্বল্পভাষী, স্পষ্টবক্তা দেবেশ ছিল সেই ধরণের সাহিত্যিক। তার স্মরণীয় উপন্যাস ' ষোল ঘড়ি কথা' এক অসাধারণ সৃষ্টি। বাংলা বিহার সীমান্তের বাহিন অঞ্চলের কুম্ভকারদের জীবনযাপন এবং তাদের কাজ নিয়ে যা ব্যক্ত হয়েছে সেই উপন্যাসে তা এক কথায় অমর সৃষ্টি। শিলিগুড়ির প্রথিতযশা অধ্যাপক/গবেষক ডঃ গৌরমোহন রায় আমাকে বলেছেন এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক অসাধারণ এবং ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। দেবেশ তখন বাহিন গ্রামীণ গ্রন্থাগারে কর্মরত।
লেখার আগে ক্ষেত্রসমীক্ষা ছিল দেবেশের বিশেষত্ব।উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিনবঙ্গের বহু পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আকাশবাণী শিলিগুড়িতেও প্রান্তিক সাহিত্যবাসরে সে অংশগ্রহণ করেছে। অনেক সম্মান সে পেয়েছে কিন্তু নিরহংকার প্রচারবিমুখ দেবেশের অনাড়ম্বর জীবন তাকে ব্যতিক্রমী মাত্রা দিয়েছে।সোজা কথা সোজাসুজিই বলতো।
তার বাড়িতে নানা সাহিত্যাড্ডায়  তার স্ত্রী এবং কন্যার আতিথেয়তা মনে থাকবে চিরকাল।
তার আর একটি প্রকাশিত গ্রন্থ ' নির্বাচিত গল্প' যার গল্পগুলোতে পাই মানুষের কথা, জীবনবোধের কথা।পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে দেখেছি ওর গল্পপাঠের সময় শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। বিভিন্ন সাহিত্যসভায় ওর নিবিড় উপলব্ধি ছিল গভীর মননশীলতার পরিচয়।
গল্পের সাথে কবিতা রচনাতেও সে ছিল সিদ্ধহস্ত। 'নব কথামঞ্জরী' সিরিজের ছোট ছোট গল্প তার গভীর মনস্তত্বের পরিচায়ক।
কর্মজীবনের পরবর্তী সময়ে সে রায়গঞ্জ মহকুমা গ্রন্থাগারে বদলি হয়ে আসে। সেখান থেকেই ২০১৫ সালে অবসরগ্রহণ করে। সেখানে রায়গঞ্জের সাহিত্যপিপাসুদের ছিল অবারিত দ্বার। গ্রন্থাগারের সদস্যদের কাছে ছিল আত্মার আত্মীয়।
আমাদের সম্পাদিত'চয়ন' পত্রিকায় তার বহু গল্প প্রকাশিত হয়েছে।ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রয়াত স্ত্রী ছিল তার গল্পের একনিষ্ঠ ভক্ত।নতুন গল্প লিখলেই মাঝে মাঝেই বাড়িতে এসে গল্প শোনাতো।
পাশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন - এগুলোর সাথে ছিল তার গভীর সংযোগ। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত 'শনিবারের সাহিত্য আসর'- এর সাথে ছিল গভীর আত্মিক বন্ধন।
দেবেশ ছিল ভালো সঞ্চালক,যুক্তিনিষ্ঠ বক্তা এবং বিশ্লেষক। ভালো প্রুফ রীডার হিসাবেও তার খ্যাতি ছিল। 'চয়ন','চৈতন্য' পত্রিকা,কমলেশ গোস্বামী,সম্পাদিত গবেষণামূলক গ্রন্থগুলির প্রুফ সংশোধনে তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। রায়গঞ্জ দেবীনগরের 'রায়গঞ্জ সমাজ কল্যাণ বিভাগ ' আয়োজিত মাসিক সাহিত্যবাসরের সঞ্চালক হিসাবে দীর্ঘ এক দশকেরও বেশী সময় দেবেশের ধারাবাহিক সঞ্চালনা ছিল মনোগ্রাহী।
রায়গঞ্জ উদয়পুরের দীপালি উৎসবের স্বরচিত কবিতা এবং প্রবন্ধগুলো ( প্রতিযোগিতামূলক) বিচারের জন্য দেবেশ বহুবার বিচারের জন্য আমার কাছে দিলে আনন্দেই করে দিতাম। এটা দাদা হিসেবে দাবী করত খোলা মনে।
জেলার মাটি এবং মানুষের প্রতি তার সহজাত টান সে কোনোদিনই ভোলেনি। উত্তর দিনাজপুর জেলা বইমেলায় তাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হতো পালন করত নিষ্ঠার সাথে।
বিগত দুর্গাপূজার পর ওর সাথে তিনবার দেখা হয়েছিল। নানা কথা ও মত বিনিময় হয়েছিল। মোবাইলে মাঝে মাঝেই কথা হতো। আমার কবিতার ভালোমন্দ দিক খোলাখুলি বলত। ওর গল্প লেখারও কথা জিজ্ঞেস করতাম। কথা বিনিময়ের সময় বুঝতে পারতাম ওর অনেক কথা ছিল ভেতরে যা প্রকাশ করতো না। মনের ভেতরে একটা কষ্টানুভূতি বুঝি কাজ করতো। দীর্ঘ ৪৫/ ৪৬ বছরের এক সাহিত্যসাথীর মনের অনুরনন যেন একটা ছায়াপথ এঁকে দিত।
 স্রষ্টার অমোঘ নিয়মে প্রত্যেকেরই জীবনের আয়ু নির্দিষ্ট। গত ১৪ই নভেম্বর জেলা বইমেলা কমিটির সভায় যাবার পথে আকস্মিক দুর্ঘটনার পর মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ শুরু হলে প্রথমে রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজে এবং পরে শিলিগুড়িতে সঞ্জীবনী নার্সিং হোমে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। কিন্তু আচ্ছন্ন হয় কোমায়।২৯শে নভেম্বর মধ্যরাত্রে রায়গঞ্জে তার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসায় তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অসংখ্য গুনগ্রাহী। ছড়াকার/কবি তুহিন কুমার চন্দের ভাষায় 'নিকটতম বাল্যবন্ধুকে হারালাম।' আশিস চক্রবর্তীর (শিলিগুড়িনিবাসী) ভাষায় 'এ শোক ভোলার নয়।' শেষমুহূর্তে হসপিটালে দেখেছি স্বজনহারা মানুষের অশ্রুসিক্ত চোখ।
দেবেশ চলে গেছে। রেখে গেছে স্ত্রী, এক কন্যা, নাতি, দাদা, বোন এবং অগনিত সুহৃদ। ওর সবচয়ে বড় কষ্ট যেটা বুঝতাম তা হল তার অপ্রকাশিত উপন্যাস 'নোনা নদীর বাঁকে', 'কনিষ্ক', 'চন্দ্রাবতী' সহ বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি। ও যখন পাঠ করত মনে হতো চরিত্রগুলো কথা বলছে।এই প্রান্তবয়সে আমিও অনেক দুঃখ ভারাক্রান্ত এবং অনেকেই। তবে গল্প/উপন্যাস/কবিতার মধ্যে যা দিয়েছে তা আমাদের মণিকোঠায় জাগরুক থাকবে। বেঁচে থাকবে ওর কাজে। চিরসত্য 'কীর্তির্যস্য সঃ জীবতি।'

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri