এই উত্তরবঙ্গে, ' ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া' - রবিঠাকুরের পদধূলি ধন্য স্থান বোধকরি একমাত্র মংপুই হতে পারে।সমতলের অসহ্য গরমের সময় পাহাড়ের গা বেয়ে কয়েক পাক এগুলেই তো ক্রিসমাস ট্রি আর প্রাণজুড়ানো ঠান্ডা বাতাস। পর্যটকদের আনাগোনা সারা বছর থাকলেও মংপুতে রাত্রিবাস করার এবং একটু সাচ্ছন্দে থাকার
সেরকম কোনো আয়োজন ট্যুরিজম বিভাগের পক্ষে এখনো করা গেল না কেন সেটা আলাদা প্রশ্ন কিন্তু তাই বলে প্রকৃতি মায়ের কোন কার্পণ্য নেই। ছোট বড় পাহাড়গুলোর সাথে লুকোচুরিতে মাতোয়ারা তিস্তার খামখেয়ালিপনার সঙ্গে যেন সামঞ্জস্য রেখেই পাহাড়ে ওঠবার পিচের রাস্তাগুলো তৈরি। তিরতির করে ঢাল বেয়ে নেমে আসা ঝরনার জলে চকচকে কাকড়া, নাম না জানা ফুলে নীল রঙের প্রজাপতি আর অতিথি বৎসল সহজ সরল মানুষগুলোর ব্যস্ততাহীন জীবনের টুকরো জলছবিগুলো বাড়তি পাওনা। আসলে এই ছোট্ট ভ্রমণের উপলক্ষ ছিলো শ্বশুর মশাইকে নিয়ে সেবকের কালীবাড়ি যাওয়া। ছোট এক টিলার মাথায় মন্দিরে পৌছতে গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি পার হতে হয়। বয়স আশি পার হওয়া 'ভালো বাবা ' খুব সহজেই এতগুলো ধাপ পেরিয়ে গেলেন দেখে সিঙ্কোনার দেশ, কার্শিয়াং-এর মংপু জনপদ যাওয়ার বাড়তি সাহসটুকু পাওয়া গেল।সেবকের খুব প্রাচীন এই মা কালী মন্দিরের বারান্দা থেকে তিস্তার দুই ধারের দুটি বিশাল পাহাড়ের দৃশ্যপট দেখা এক দারুন অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির রূপের সাথে মন্দিরের ভিতরের পরিবেশও বেশ মানানসই।চা এর দোকান গুলোর পাশ দিয়ে সামরিক বাহিনীর ভারী যানবাহনের চলাচল লেগেই আছে। ইংরেজদের তৈরি করা সেই ১৯৪১ সালের এই সেবক ব্রীজ বা বাঘপুলকে আর কতদিন যে একা কুম্ভ হয়ে সমগ্র পূর্ব ভারতের সংযোগস্থল হয়ে থাকতে হবে কে জানে!করোনেশন ব্রীজকে ডানহাতে রেখে চড়াই এর পথ বেয়ে গাড়ি চলতে শুরু করলে যাত্রাপথটিতে তিস্তার সবুজ জলই মুখ্য আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। মন-মোহিনী তিস্তা ক্রমশ সরু ফিতার মতন হয়ে পাহাড়ের কোলে হারিয়ে যেতে থাকলে, গাড়ির জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের আহ্বান যেন বলতে চায়, পাহাড়ি সৌন্দর্যকে ক্যামেরায় বন্দী করার সময়ের শুরু এখন থেকে!মংপুতে পৌছে রবীন্দ্র ভবন খোলা না পাওয়ায় যাত্রার উদ্দেশ্যই এবারে পণ্ড হলো।করোনা বিধি মেনে সিঙ্কোনা প্লান্টেও প্রবেশ নিষেধ।তৎকালীন সিঙ্কোনা প্রকল্পের মুখ্য আধিকারিকের সহধর্মিণী মৈত্রেয়ীদেবীর সৌজন্যেই কবির একাধিকবার মংপুতে আগমন। কিন্তু এই বাংলোটির সংস্কারের যে আশু প্রয়োজন তা বাইরে থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল। ফেরার সময় পাহাড়ের একটা বাঁক আমাদের এই ছোট্ট ট্যুরের সব অতৃপ্তি যেন মিটিয়ে দিল। খড়ের ছাউনি করা একটা ছোট্ট ভিউ-পয়েন্ট, প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে যে অপেক্ষা করছিল সেটা আগে থেকে বোঝা যায়নি। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের গায়ে আলতো করে লেপ্টে থাকা তিস্তা আর রঙবেরঙের পাহাড়ি ফুলের ঐশ্বর্যের মধ্যে কিছুটা সময় কাটিয়ে মনে হল আমরা কাছেপিঠে থাকা ডুয়ার্সের বাসিন্দারা সত্যিই ভাগ্যবান!