সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
02-December,2022 - Friday ✍️ By- শঙ্খনাদ আচার্য 405

সেবারকার শীতকালীন ভ্রমণ/শঙ্খনাদ আচার্য

সেবারকার শীতকালীন ভ্রমণ
শঙ্খনাদ আচার্য
=========================

বেড়াতে ভালবাসে না এমন মানুষ বিশেষত বাঙালি খুঁজে পাওয়া দায়। শত কর্মব্যস্ততার মাঝে দু দিনের ছুটি পেলেই মন ডানা মেলে উড়তে চায় অচেনা দিগন্তের ক্যানভাসে। তবে শীতের ভ্রমণ নিয়ে আলাদা একটা উন্মাদনা কাজ করে ভ্রামনিকদের মধ্যে। কারণ শীতকালের রোদঝলমলে দিনেই সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যায় ল্যান্ডস্কেপ। ভ্রমণ রসিকেরা তাই বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলে-পাহাড়ে সে হোক না একদিনের জন্য।
ফি বছরই ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমরা সপরিবারে একদিবসীয় ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ি। ২০১৯-এও তার কোনোরূপ অন্যথা হয়নি। পরিবারের সকলের কথা মাথায় রেখেই ডিসেম্বর মাসের শেষ রবিবার টিকেই আমরা বেছে নিলাম বেড়াতে যাওয়ার জন্য। তা সত্ত্বেও পরিবারের সকল সদস্যের যাওয়া সম্ভব হলো না। অগত্যা কয়েকজনকে বাদ রেখেই আমাদের বের হতে হলো। এবার বেরোবার আগে কয়েকজন ভ্রমণ পিপাসু ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে পাহাড়-জঙ্গল মেশানো একটা ভালো ভ্রমণ-পরিকল্পনার চেষ্টা করেছিলাম। সেই মতো স্থির হলো চাপরামারি অরণ্যভূমি, গৈরিবাস রবার বাগান হয়ে কুমাই এবং কুমাই থেকে রকি আইল্যান্ড হয়ে সময় পেলে মুর্তি হয়ে ফেরা। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই পথে এটাই আমাদের প্রথম যাত্রা।
এবার এল পরিকল্পনাগুলোকে বাস্তবায়নের দিন। কথা মতো রবিবার আমাদের সারথী ভক্ত তার বাহন নিয়ে ঠিক সাতটার সময় বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। আমরাও তৈরি হয়ে সাড়ে সাতটার মধ্যে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছুটতে শুরু করল কাকিমার বাড়ির উদ্দেশ্যে, সেখানে কাকিমা ও ভাই কে গাড়িতে তুলে আমাদের গাড়ি যখন আবার ছুটল ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা ছুঁই ছুঁই। ওদিকে কুচবিহারে রাঙা কাকা,কাকিমা, সুতপা, বোবো ও মুনমুনদি (সুতপার দিদি) আমাদের অপেক্ষায় ছিল। প্রায় পোনে নটায় কুচবিহারে ঢুকে জলখাবার খেয়ে দুটো গাড়ি নিয়ে ,আর অতি অবশ্যই গুগল ম্যাপের উপর ভরসা রেখে আমরা আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
পুন্ডিবাড়ি, ফালাকাটা,জটেশ্বর হয়ে বীরপাড়ায় মিনিট পাঁচেকের বিরতি নিয়ে আবার গাড়ি ছুটল। অবশ্যই বীরপাড়ায় দাঁড়ানোর একটা উদ্দেশ্য ছিল সাজুদার (বীর বিরসা মুন্ডা বস্ত্র ব্যাঙ্কের কর্ণধার) সঙ্গে দেখা করা। তবে দুর্ভাগ্য ফোনে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম সাজুদা শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। তবু ওনার ছেলেদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য একবার নামলাম। নাগরাকাটা হনুমান মন্দিরের সামনে আমাদের পরের বিরতিটা ছিল বাধ্যতামূলক। কারণ ওই সময় আমাদের দুই ক্ষুদে সহযাত্রীর, মানে ম্যাও ও বোবোর মধ্যাহ্নভোজনের সময়। মিনিট তিরিশের বিরতি নিয়ে আমাদের গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করল। জলঢাকা নদী পেরিয়েই আমরা এ যাত্রায় প্রথম জঙ্গলের স্বাদ পেলাম। কিছুক্ষণ পর খুনিয়া মোর থেকে ডান হাতে ঘুরে আমাদের গাড়ি চাপরামারি বন্যপ্রাণ আরক্ষ্যালয়ের বুক চিরে চলে যাওয়া জমাট বাঁধা কাজলরেখার মতো পিচের রাস্তা ধরে কুমানি চেকপোস্ট অভিমুখে চলতে শুরু করল। ঘন জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে আমাদের গাড়ি যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তার ঠিক দ্বিগুণ গতিতে দু'পাশের বড় বড় গাছগুলো ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। চারিদিকে গা ছমছম করা এক অসার নিস্তব্ধতা। মাঝেমাঝে উল্টো দিক থেকে আসা এক একটি গাড়ি জানান দিয়ে যাচ্ছে এই গহীন জঙ্গলে আমরা একা নই। কিছুদূর যেতে না যেতেই একটি বাঁক ঘুরে সামনে কয়েকটি ছোট গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমরাও গাড়ি থামালাম। গাড়ির জানালা দিয়ে একটু মাথা বের করে দেখতে পেলাম গাছের গুড়ি দ্বারা নির্মিত মস্ত বড় এক তোরণ, আর তাতে গোটা গোটা হরফে লেখা "CHAPRAMARI WILDLIFE SANCTUARY", যে লেখাটিকে মেঘমুক্ত সুনির্মল আকাশের প্রতিফলন এক নীলাভ আভা দিয়েছে । এভাবেই আমরা পৌছে গেলাম আমাদের প্রথম গন্তব্যে। যেহেতু ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ তাই মুহূর্তের মধ্যে ওখানেই আমাদের ছবি তোলার হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল। ওই স্থানটি পেছনে ফেলে আসবার আগে বাবা ও রাঙাকাকার কথামতো তোরণদ্বার কে পেছনে রেখে একখানা পারিবারিক ছবিও তোলা হলো। ওই যে কথায় বলে না "বাড়ি যদি একটা শরীর হয়, পরিবার হলো তার হৃদয়"। যদিও এবারকার ছবিতে "হৃদয়ের" একাংশই মাত্র দেখা যাচ্ছে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হল গৈরিবাস রবার বাগান। সেইমতো গাড়ি গাড়ি ছুটল কুমানি চেকপোস্টের দিকে। যতই গাড়ি এগিয়ে যেতে লাগলো অরণ্যও তার ঘনত্ব বাড়াতে লাগলো। এই ঘন জঙ্গল বিদীর্ণ করে মাটিকে ছুঁতে চাওয়া রোদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি। কুমানি চেকপোস্ট থেকে ডান হাতে ঘুরতেই শুরু হলো পাহাড়ী পাকদণ্ডী বেয়ে চড়াই-উৎরাই। রাস্তাও সর্বত্র মসৃণ নয়।গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার ঠিক কোন পাশের প্রাকৃতিক শোভায় নিজেকে ডুবিয়ে নেব এটা ঠাহর করতে আমাদের সকলেরই বড্ড অসুবিধে হচ্ছিল। তবে কখন যে ঘন জঙ্গল,বনছায়া, পাহাড়ি পথ, পাহাড়ি গাঁ, ছোট ছোট ঝোরা আর ইতি ইতি সহজ-সরল কিন্তু কঠোর পরিশ্রমী পাহাড়ি মানুষগুলোর মুখ- সব মিলেমিশে এক মায়াবী আবেশে জড়িয়ে পড়েছিলাম তা বুঝতেই পারিনি। ঘড়ির কাঁটায় তখন কটা বাজছে সেসব দেখার মত ফুরসত কারোরই ছিল না। তবে হ্যাঁ সময় বাঁচাতে রবার বাগান এর ছবি তোলা আর হয়ে ওঠেনি। ডিসেম্বর মাসের শেষ রবিবার হওয়ায় ওই দিন রবার বাগান এর পাশেই একটি ছোট্ট পাহাড়ি নদীর দুই তীরেই বহু মানুষের ভিড় দেখতে পেলাম। অবশ্যই তাদের সকলেরই উদ্দেশ্য-বনভোজন। আমাদের গাড়ি ওখানে ঘুরিয়ে আবার ওই পথেই ফিরে এসে কুমানি চেকপোস্ট হয়ে রওনা দিলাম কুমাই-এর উদ্দেশ্যে। কুমানি চেকপোস্ট থেকে মেরে-কেটে ৫-৬ কিলোমিটার দূরেই পাহাড়ের কোলে আমাদের সাথে দেখা হলো সেই ছবির মতো সুন্দর এক ছোট্ট পাহাড়ি জনপদের, যার নাম কুমাই। রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একইরকম নাম-না-জানা সব গাছ, পাহাড়ের কোলে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ গালিচার মতো চা বাগান, রংবেরঙের ফুলের বাগানে সুসজ্জিত এক একটি বাড়ি-সর্বত্রই যেন শিল্পীর তুলির নিখুঁত ছোঁয়া। সময় সংকীর্ণ হওয়ায় এযাত্রায় এইসকল নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য গাড়ির ভেতর থেকেই উপভোগ করতে হলো। যা এখানে ফিরে আসবার আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রাখল।
হাতের ঘড়ি দেখবার অবকাশ না পেলেও মাথার উপর মেঘমুক্ত সুনীল আকাশে সূর্যদেবের অবস্থান জানান দিচ্ছিল বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। ততক্ষনে আমরাও বুঝতে পেরে গেছি যে আর বেশিক্ষণ এই পাহাড়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দিবালোকে উপভোগ করা একপ্রকার প্রায় অসম্ভব। তাই আমরাও আর দেরি না করে এগিয়ে চললাম আমাদের শেষ গন্তব্য রকি আইল্যান্ডের দিকে। কুমাই এর পাহাড়ি পথ ধরে রকি আইল্যান্ড পৌঁছতে আমরা যখন নেমে আসছি হঠাৎ বোবো বলে উঠল "বাবা আমরা পাহাড়ে কখন উঠব?" বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ম্যাও-র উত্তর "আরে বোকা আমরা তো পাহাড়েই আছি।" এভাবে মাঝে মাঝেই ওদের কথোপকথন সুদীর্ঘ যাত্রাপথে আমাদের প্রাণ খুলে হাসার রসদ জোগাচ্ছিল। এই হাসি মজার ছলেই আমরা পৌঁছে গেলাম রকি আইল্যান্ডে। হাতেগোনা কয়েকটি দোকান, হোম স্টে, একটি বিলাস বহুল হোটেল আর কিছু বাড়ি-ঘর নিয়েই মূর্তি নদীর দুই তীরে পসরা জমিয়েছে রকি আইল্যান্ড। গাড়ি থেকেই দেখতে পেলাম শীর্ণকায় বেগবতী নদীবক্ষে ছোট-বড় পাথরের আশেপাশে অগণিত ভ্রামণিকদের ভিড়। আর রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। সরু পাহাড়ি রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকদের গাড়িগুলোর ভিড়ে ঠিক প্রিয়াঙ্কা হোম স্টে-র সামনে আমরাও আমাদের গাড়ি দুটো রেখে সবাই মিলে গাড়ি থেকে নামলাম। এরপর সকলে মিলে হেঁটে চললাম নদীবক্ষে নামার প্রস্তুতি নিয়ে। ওদিকে ভক্ত, মানে আমাদের সারথী বলে দিল তোমরা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে এসো আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি। একেতো রবিবার তার ওপর আবার বছরের শেষ রবিবার স্বভাবতই পর্যটকের ভিড়ে চারিদিক তখন গমগম করছিল।
মা ,কাকিমা আর মুনমুনদি বাদে আমরা সবাই নদীবক্ষে নামতে শুরু করলাম। আমরা যখন নামছি তখন পশ্চিম দিকের পাহাড়ের গায়ে মুখ লুকোবার আগে আগে শেষবারের মতো সূর্যদেব উঁকি দিচ্ছেন। যার ফলে পুবের পাহাড়ের গায়ে সূর্যালোকের এক অপূর্ব বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছে। ছোট-বড় ও বিশালাকায় নানা পাথরের সমাহার, স্রোতস্বিনী মূর্তির কলতান আর পাহাড়ের গায়ে রোদ-ছায়ার জলসা সত্যিই সেইসময় যেন এক অপরূপ মূর্ছনা তৈরি করেছিল। এই সেই রঙ্গময়ী রকি আইল্যান্ড -জ্ঞান হবার পর থেকেই যার মোহময়ী রূপের কথা বহুবার,বহু আঙ্গিকে, বহু জনের কাছে শুনেছি কিন্তু কোনদিন আসা হয়ে ওঠেনি। বহু প্রতীক্ষার পর মূলত যার টানে এবারের বেড়িয়ে পড়া আমরা সেই রকি আইল্যান্ডের মুখোমুখি হলাম শীতের এক পড়ন্ত বিকেলে। আর তারপর পাথরের ওপর বসে সকলে মিলে নদীর জলের হিমশীতলতাঁর স্পর্শ পায়ে মেখে সেখানকার অপরূপ সৌন্দর্যে আমরা কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে ডুবে রইলাম। সেই অনন্য নিসর্গ প্রাণভরে উপভোগ করবার আগেই খাবারের জন্য ডাক পড়ল। ঝুলন্ত সেতু থেকে রীতিমত ধমকের সুরে খাবারের জন্য বাবার ডাক সেই সময় উপেক্ষা করবার আর জো ছিল না। কারণ আমাদের অপেক্ষায় বড়ো'রা সবাই বসেছিল। নদীকে পেছনে ফেলে ওপরে উঠে আসবার সময় বোবোর শিশুমনের সারল্যমাখা একটি কথায় সত্যিই যেন এ যাত্রার সার্থকতা অনুভূত হল - " বাবা ভক্ত মামা এবার একটা ভালো জায়গায় নিয়ে এনেছে।"
'অপরাহ্নের' আহার সেরে এবার ছিল চালসা হয়ে ঘরে ফেরার পালা। পাহাড়ী পাকদন্ডী ধরে আমাদের দুটো গাড়িই চালসা-র দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। পুরোপুরিভাবে সূয্যি পাটে যাবার আগে সামসিং চা বাগানে আমরা থেমেছিলাম ঐ অপরূপ আলোয় ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে। কিছু স্মৃতি লেন্স বন্দী করে আর কিছু হৃদয়ে জড়িয়ে এবং নতুন বছরের জীবন-সংগ্ৰামে লড়বার ভরপুর প্রাণশক্তি বুকের মধ্যে সঞ্চারিত করে আমরা যখন চালসায় এসে পৌঁছলাম তখন রীতিমতো আঁধার নেমে এসেছে।চালসা থেকে খুনিয়া মোড় হয়ে ঐ একই পথে বাড়ির দিকে তীব্র গতিতে ছুটে চলল আমাদের বাহন। অনাবিল আনন্দে ভিজে এবং আবার ফিরে আসবার অভীপ্সায় সেবারকার মতো শেষ হল আমাদের শীতকালীন ভ্রমণ।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri