ব্যস্ত লেবং কার্ট রোডের ওপর এমন নিঝুম বিবর্ণ একখানা হোম স্টে থাকতে পারে এটা ইরার ধারনা ছিল না। ধুলো পড়া একফালি বারান্দাটা থেকে খাড়া সিঁড়ি নীচে চলে গেছে পিঠে ব্যাগটা নিয়ে সন্তর্পনে নামছিল ও, পেছনে মিঠি, ওর কিশোরী কন্যা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটি সরু প্যাসেজের মুখে দাঁড়িয়েএকটি মেয়ে, মাস্ক পড়া থাকলেও বোঝা গেল অল্পবয়সী, পাশে একজন প্রৌঢ়া, মৃদু হেসে ওদের ঘর দেখিয়ে দিল, সাকুল্যে তিনটি ঘর, নীচু ছাদ,
অন্ধকার অন্ধকার...ইরার মনে হচ্ছিল যেন ওরা মাটির নীচে এসে ঢুকেছে। কটমট করে ধ্রুবর দিকে তাকাতেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ধ্রুবর জবাব, "এই হোলির সময় এখানে হোটেল ফোটেল পাওয়া যায় নাকি! একরাতের তো ব্যাপার এখানেই কাজ চালিয়ে নে...কী বলো রূপকদা?"
ইরার বর ও সায় দিল এককথায়। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘরে পা দিল ইরা। অন্য কোনও ট্যুরিস্ট নেই, তিনটে ঘরে ওরা তিন পরিবার। মিঠিও কেমন যেন গম্ভীর হয়ে আছে। ঢোকার সময় ইরা দেখেছিল আশেপাশে তেমন মানুষজনের বাস নেই। বাঁ দিকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস আর ডান দিকে কী আছে বোঝা গেল না। পাহাড়ের ঘরবাড়ি তো ধাপে ধাপে তৈরি হয় সেরকম ই কিছু আছে বোধহয়। মাস্ক পড়া মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে ওদের কিছু প্রয়োজন কিনা জানার জন্য, সবার ই চা তেষ্টা পেয়েছে। মেয়েটি বলল,পাঠিয়ে দেবে এক্ষুনি।
"পেছনের ব্যালকনি থেকে খুব সুন্দর লাগে দেখতে আশ পাশ যা দেখে আয়।"
ধ্রুবর কথা শুনে সরু প্যাসেজ টা পেরিয়ে ইরারা গেল ব্যালকনিটায়, সত্যি অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যপট!! দূরে পাহাড় দেশলাই বাক্সের মতো ছোট্ট ছোট্ট বাড়িঘর, পাকদন্ডি পথ, ধুপি গাছের সারি ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের ছবি!! ডান দিকে চোখ পড়তেই সহসা থমকেছে ইরা, অনেক টা নীচে এক বিশাল যীশুর মূর্তি আর ওপরের রাস্তা থেকে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে কবরগুলো। এ শহরের অন্যতম প্রাচীন গ্ৰেভ ইয়ার্ড। সবথেকে কাছের কবরটি হোম স্টে থেকে বড়জোড় চার মিটার দূরত্বে। ধ্রুবর বৌ স্মিতার আবার ভূতের ভয় খুব। জয়াও একটু ভয় পেয়েছে মনে হল। ইরার ওসবে ভয় নেই বরং যীশুর মূর্তি টা দেখে একটু আগের বিরক্তির ওপর প্রশান্তির প্রলেপ পড়ল যেন।
রুমে এসে মেয়েকে বলল ও সে কথা। মিঠি তখন ও মুখ ভার করে বসে আছে।
ও মা, বাবাকে বল না, অন্য হোটেল খুঁজতে, আমার ভাল লাগছে না এখানে।
একটু অ্যাডজাস্ট কর বাবু, একদিনের তো ব্যাপার।
মেয়েকে বলতে বলতে বাথরুমের দরজাটা খুলল ইরা, আর সাথে সাথে গা গুলিয়ে বমি উঠে আসে ওর.…বিকট এক দুর্গন্ধ!! পচা আঁশটে একটা গন্ধ ওকে যেন ধাক্কা মেরে বের করে দিল বাথরুম থেকে অথচ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাথরুম। মায়ের অবস্থা দেখে মিঠিও চমকে উঠেছে।
কি হয়েছে মা? ওরকম করছ কেন?
ওফ্!! বিচ্ছিরি একটা গন্ধ বাথরুমে, মনে হয় রোদ পড়ে না বাড়িটায় তাই ওরকম গন্ধ।
ক ই একটু আগে তো আমি গেলাম, পাইনি তো!!
অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকায় ইরা মেয়ের দিকে।
হৈহৈ করে সবাই বেড়িয়ে পড়ল ওরা ম্যালের উদ্দেশ্যে। ইরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন।
প্রচুর ঘুরে রাতে ফেরার পর আড্ডা জমল ব্যালকনি তেই। সবার মনে একটাই প্রশ্ন এত সুন্দর ব্যালকনিটা এত অগোছালো ধূলোময় কেন!! মনে হয় বাড়ির লোকজন এদিকটায় আসেই না। ইরা কিন্তু ফিরে এসে সেই গন্ধটা আর পায়নি, তখনকার সেই বিরক্তিকর ফিলিংস টাও অতটা ছিল না। যাই হোক আধো অন্ধকার বারান্দায় ভূতের গল্প তো হ ওয়ার ই ছিল হচ্ছিল ও তা। কিন্তু ইরার বর ভূতের অস্তিত্ব মানতে নারাজ, ওর একা, নির্জন জায়গায় থাকার অনেক অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু কোনোদিন কিছু দেখা তো দূর অস্ত অনুভব ও নাকি হয়নি। ইরা কিন্তু প্রবল ভূতে বিশ্বাস তবে ভীতু নয়। এর মাঝেই মিঠি, -মা বলে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল, উঠে দুই পুঁচকে বোনেদের সাথে খেলতে চলে গেল।
ইতিমধ্যে ডিনার নিয়ে মাস্ক পড়া মেয়েটি হাজির, সাথে ওর মা, ভেজ মাঞ্চুরিয়ান, আলুভাজা, ভাত,ডাল, ওমলেট, রুটি আর ডোলে খোরসানির আচার। ওরা কিন্তু খাওয়ার গুলো ঘরেই দিয়ে চলে গেল, ব্যালকনি তে এল না। ইরারা সবাই মিলে সেগুলো ব্যালকনির টেবিলে সাজিয়ে ফেলল। খাওয়া দাওয়ার পর ও আড্ডা চলল। ইতিমধ্যে ওর ঘুমকাতুরে বর - "ওঃ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে" বলেই শুতে চলে গেল।
পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে গেল ইরার। গায়ে চাদর জড়িয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে করে প্যাসেজের দরজাটা খুলল, দরজার ঠিক ওপরে তারা মায়ের ছবি, এ এলাকায় তারা মায়ের ছবি দেখতে পাওয়া একটু আশ্চর্য বৈকি!! যাই হোক একা একা ইরা এসে দাঁড়ায় ব্যালকনি তে, এখনও অন্ধকার, দূরে পাহাড়ের গায়ে ঝলমলে আলোগুলো এখন রাত শেষের আলস্য মেখে স্তিমিত অনেকটাই, স্ট্রিট লাইটের ম্লান আলো আর কুয়াশা মেখে মায়াময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেরিপুত্র। পাহাড়ের ধাপে ধাপে সার দেওয়া কবরগুলো নিঃস্তব্ধতা কে বাড়িয়ে দিয়েছে আরো। বড় ভাল লাগছিল ইরার এই খন্ড সময়টুকুকে একান্ত নিজের করে পেয়ে। আস্তে আস্তে পরিস্কার হয়ে উঠেছে আকাশ। ইরা পায়ে পায়ে ফিরল নিজেদের ঘরে। হাত ঘড়ি দুটো পাশাপাশি রাখা সময় দেখতে গিয়ে দেখে দুটো ঘড়িই সাড়ে চারটের সময় বন্ধ হয়ে আছে!!
-"এ আবার কী!!" মনে মনে ভাবে ও। হটাৎ ঘরের কোনে আলমারির মাথায় চোখ পড়ে, তারা মায়ের ছবি, ঘট রাখা। এমনভাবে যেন চট করে চোখে না পড়ে। ইরা অবাক হয়, পুজোর জিনিস এত লুকিয়ে রাখার কী আছে!!
সবাই মোটামুটি উঠে পড়েছে, ইরা মিঠি কে হটাৎ জিজ্ঞাসা করল কাল কি বলতে গিয়ে চুপ করে গেলি রে? এদিক ওদিক দেখে মিঠি ফিসফিস করে বলল,
-"মা, জানো, কাল হোম স্টেতে পা দিয়েই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আর ভীষন রাগ হয়ে গেল মনে হচ্ছিল এখুনি এখান থেকে চলে যেতে বলছে কেউ।"
-"তুই কিছু দেখছিস?"
-"না মা, শুধু একটা নেগেটিভ ফিল হচ্ছিল। হয়ত এমনিই তাই তখন বলিনি কিছু।"
কিছুক্ষণ বাদেওদের ঘরেই চা খাচ্ছিল সবাই, হটাৎ ইরার বর বলে উঠল, -"জানিস এতদিন আমার যে অভিজ্ঞতা হয়নি গতকাল রাতে হয়েছে"
-"মানে!!" পলকে জয়া আর স্মিতার চোখ বড় বড়, ইরা তাকিয়ে আছে উৎসুক মুখে।
-"আমি শোওয়ার আগে বাথরুমে ঢুকতেই, আমার শরীর ভারী হয়ে গেল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল…"
- "তারপর!!"
-"তারপর আর কি, কেমন যেন একটা অনুভুতি হল, ব্যাস্!!"
ইরা চুপ করে ব্যাপার গুলো ভাবতে চেষ্টা করে, এর মধ্যে জয়া বলে ওঠে
-"এই ঘরের আলমারির ওপরে দেখেছ?? কোনের দিকে ঘট-টট কিসব রাখা!!"
-"চল চল রেডি হয়ে নাও সবাই" বরের কথায় চটকা ভাঙে ইরার।
ঠিক হল সব লাগেজ প্যাক করে একটা ঘরে রেখে দিয়ে ওরা বেরিয়ে ফেরার পথে লাগেজ গাড়িতে তুলে নেবে। সেই মতো রেডি হয়ে বেরিয়ে এল সবাই। ইরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল হোম স্টে টার দিকে। পাহাড়ের একটা বৈশিষ্ট্য হল ফুল, প্রত্যেক বাড়িতেই অজস্র ফুল ফুটে আলো হয়ে থাকে কিন্তু এ বাড়িটা ব্যতিক্রম!! একটা গাছ ও নেই। ট্যুরিস্টদের জন্য ও যে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে তার যেন কোনো ইচ্ছেই নেই।
-"জানোতো মা, আমরা যে ছিলাম তার নীচেও ঘর আছে, আমি আর বাবা গিয়েছিলাম। ঘরগুলো অনেক পুরনো কোনোদিন মনে হয় খোলা হয় না...কেমন যেন… ওখানে কোনো নেগেটিভ এনার্জি ছিল ঠিক"
-"কিন্তু আমরা তো পজেটিভ ছিলাম"
-"হ্যাঁ হয়ত সেই কারনেই তার এনার্জি কমে গিয়েছিল"
-"কার??"
মেয়ের দিকে তাকায় ইরা, দেখে মৃদু হাসিমুখে মেয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিবর্ণ হোম স্টে টার দিকেই। দিনের ব্যস্ত লেবং কার্ট রোডের ওপর দাঁড়িয়ে সহসা গা ছমছম করে ওঠে ইরার।