সাগরবন্যা/মিলি ভট্টাচাৰ্য
সাগরবন্যা
মিলি ভট্টাচাৰ্য
===========
আসবে সে আসবে, ঠিক আসবে,
পশ্চিম দিগন্ত রাঙা করে যেই সুয্যটা ডুববে, লহর তুলে নেচে নেচে সে আসবে... শুখা বালিয়ারি ভিজিয়ে সাদা ফেনিল স্নেহ মাখিয়ে নৃত্যপরা বালিকার মতো সে আসবে... প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল
সাগরপারের সদ্য বন্ধু হওয়া জেলে ভাই l
আমরা ষোলোজন সাগরপিয়াসী বুভুক্ষু পর্যটক বকখালির বালিয়াড়িতে অপেক্ষমান তখন।
দূরে, বহুদূরে দিকচক্রবালে সমুদ্র রেখা, আমাদের বাইনোকুলারে ধরা দিল সে ভাসমান মাছধরার নৌকা সমেত। অপরাহ্নর সূর্যের সাথে তার আলাপচারিতা চলছে, সাগর কখন জোয়ারের পদধ্বনি শুনবে, কখন ভাসবে, কখন ভাসাবে তারই অপেক্ষা আর মুহূর্তগোনা।
আমরা ষোলোজন, ছোট্টবেলার এলাটিং বেলাটিং সই লো, সাথে কিছু ছানাপোনা এবং দুই জন বন্ধু সুজন (আমার আর মিঠুর স্বামীপ্রবর ) কলকাতা থেকে সড়কপথে রওনা হয়েছিলাম বকখালির উদ্দেশ্যে। সকাল ছটায় গাড়ি ছাড়ল, ছোট্ট বাস, হালকা ব্যাগপত্তর নিয়ে কলকল করতে করতে আমরা উঠে পড়লাম বাসে। পঞ্চাশের দোরগোড়ায় পৌঁছেও কৈশোরের প্রাণচঞ্চল উত্তাপ ফিরে পাচ্ছিলাম, বেশ হালকা ফুরফুরে মেজাজে বাসের সিটে বসলাম।
আমাদের শিশু কিশোর সদস্যরা
তখন জুলজুল চোখে দশ জন মায়ের কীর্তিকলাপ দেখে যাচ্ছে বাকরহিত হয়ে। ওরা হল্লা করবে কী? আমাদের হা হা হি হি, কথার ঢেউএর ধাক্কায় এক্কেবারে চুপ মেরে গেছে। ওরে বাবা, মা দের কী হল, একি বিচিত্র রূপ! কেউ গান ধরেছে, কেউ হাত পা নেড়ে তাল দিচ্ছে, কেউ বারবার উত্তেজনায় সিট্ ছেড়ে উঠে পড়ছে... ছোট্টবেলার স্কুলবাস যেন! বয়স তো তখন উল্টোপথে হাঁটা দিয়েছে। হালকা টুকটাক খাওয়া চলছে বাসের মধ্যেই, কিন্তু মন তখন চা চা করছে, শীতের মিঠে রোদ জানলা দিয়ে ঢুকে পড়েছে উষ্ণতা দেবে বলে, সেই মিঠে রোদ কে আরও মিঠে করে দিলাম আমরা প্রাণখোলা হাসি আর গানের আদরে।
বাস ছুটে চল্লো বোম্বে সড়ক ধরে l
বিস্কুট, কেক, কমলালেবু, চিড়েভাজার ভান্ডার প্রায় শেষ, মন চা চা করছে সবার, বাচ্ছারাও অস্থির। রোক কে... রোক কে..
সামনেই বিখ্যাত আমতলার ধাবা, ধুপধাপ করে নেমে পড়লাম সবাই বাস থেকে। শীতের রোদ বেশ কড়া, ঘড়ির কাঁটা বেলা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। হাত মুখ ধুয়ে গরম গরম আলু পরোটা, সবজি আর চা, আর কেউ কেউ ডিমের ওমলেট। উদর পূর্তি, মনে ফুর্তি।
ধাবার প্রশস্থ পরিসরে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে বাচ্ছারা আর গোল টেবিল ঘিরে দশজন বাল্যবান্ধবীর মৌতাত। বক মধ্যে হংসের মতো আমার এবং মিঠুর পতি পরমেশ্বর তখন নির্দেশক পরিচালকের ভূমিকায়। তাঁদের তাড়নায় মৌতাত ছেড়ে আমরা আবার বাসগামী গন্তব্য ডায়মন্ডহারবার, সেখানে গভঃলজে লাঞ্চ বুক করা আছে।
ডায়মন্ডহারবার পৌঁছেই বিস্তীর্ণ মা গঙ্গার শান্ত সমাহিত রূপ, ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ খেলে যাচ্ছে তীর ছুঁয়ে, মাথায় তাদের ঝিলমিল রোদের টোপর! অথৈ জল এখানে, কাছেই হলদিয়া বন্দর।
লাঞ্চে ঝরঝরে সাদা ভাত., মুগডাল, বেগুনভাজা, বাটা মাছ ভাজা, ইলিশ পাতুরি, ট্যাংরা ফুলকপি, জলপাই চাটনি দই, মিষ্টি... বাপ্ রে, এলাহি আয়োজন! চটজলদি আহার সেরে আমরা কজন তখন গঙ্গার তীরে, রোদ ছায়ায় ঝিরঝিরে বাতাসে... নয়ন মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, এখানে থেকে গেলেই বেশ হত, সাক্ষাৎ হল, আলাপ হল কই নদীর সাথে?
আমাদের নির্দেশক পরিচালকদ্বয় তখন মিষ্টি হেসে মিষ্টি পান নিয়ে হাজির,মুখে পান, মনে গান নিয়ে আমরা আবার চরৈবেতি, চরৈবেতি, এইবার গন্তব্য বকখালি।
বকখালি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর আড়াইটে, ক্যাসুরিনার ঝাউয়ের ছায়ায় বাস এসে দাঁড়াল, শহর নয়, একেবারে প্রান্তিক বকখালি, শহুরে চাকচিক্য, ঝুটঝামেলা থেকে দূরে সাগরের তীর ঘেঁষে একতলা বাগান বাড়ি, কেয়ারটেকারের তত্ত্বাবধানে রেখে গেছেন বাড়ির মালিক l শুনশান পরিবেশে ক্যাসুরিনার জঙ্গলে সাগরের মুখোমুখি কৈশোরগন্ধী আমরা কজন এই নির্জন বাংলোয়।
দূরে বহুদূরে অপরাহ্নর আলো মেখে সাগর স্বপ্নে বিভোর, উত্তাল ঢেউ বিশ্রাম নিচ্ছে বোধহয়। ভাঁটা চলছে, বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি তখন লাল কাঁকড়াদের স্বর্গরাজ্য....
আমরা ছানাপোনা সমেত তখন অধীর হয়ে জোয়ারের প্রতীক্ষায়, কখন আসবে ধেয়ে সেই সাগরকন্যা?
তারপর, এলো, সে এলো, জলোচ্ছাস নিয়ে এলো, এক বুক ভালোবাসা নিয়ে এলো, আমাদের আরও একবার উথাল পাথাল শৈশবে কৈশোরে ভাসিয়ে নেবে বলে এলো।
আমরা দশজন মা আর ছানাপোনারা তখন আর নিজেদের মধ্যে নেই। আমাদের দুই দুষ্টু বান্ধবী সোমা সংযুক্তা লুকিয়ে আবির এনেছিল, অকাল বসন্তে আবির রাঙা হল কৈশোরগন্ধী কয়েকটা মন!
"রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে ".....
ঢেউয়ের মাতামাতি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল বয়সের ভার,গাম্ভীর্যের ভার, হয়তো বা জীবনের ভারও।
বহু দ্রষ্টব্য স্থান ভ্রমণ করেছি, আনন্দ নিয়েছি, অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত হয়েছি কিন্তু এত নির্মল আনন্দ!!!!
সারাজীবনের অক্সিজেনের রসদ হয়ে রইল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴