গ্রামীণ পর্যটনের আদর্শ গ্রাম চুইখিম
গৃহবন্দী জীবন। ঘরে বেশিদিন থাকলেই হাঁপিয়ে উঠি। কাছেদূরে বেড়িয়ে যাই প্রকৃতি এবং মানুষের খোঁজে। উত্তরের এই পাহাড়, নদী, জঙ্গল, মাটি, আকাশ, বাতাস, সর্বোপরি বিভিন্ন জনজাতির মানুষ, তাদের জীবন যন্ত্রণা, ভাষা, সংস্কৃতি যেহেতু আমার লেখার প্রধান বিষয় তাই আমাকে বের হতেই হয় পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্সের নিসর্গে। কিন্তু দুই বছরের কাছাকাছি হতে চলল শুধু ঘোরার স্বপ্ন দেখা আর পুরনো ঘোরার স্মৃতিগুলো রোমন্থন করা। তাই সুযোগ পেয়েই সপরিবারে প্রকৃতির রূপসুধা অবগাহন, চুইখিমের ইকো টুরিজম কেমন চলছে সেই বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া আর সর্বোপরি সাসটেনেবল টুরিজম সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়ার জন্য আবার এলাম চুইখিমে। হোম স্টে টুরিজমের নতুন ধারণাতে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কি ধরণের কাজ হচ্ছে বা সত্যিই ইকো টুরিজম বা সাস্টেনেবল টুরিজম নিয়ে কাজ হচ্ছে কিনা তার সুলুক সন্ধান করতে তথা গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে খোঁজখবর করাই মূল উদ্দেশ্য। বাগরাকোট পেরোবার পর শুরু হলো আঁকাবাঁকা অরণ্যঘেরা পথ। আমরা প্রথম ২০১৯ সালে যখন গিয়েছিলাম তখন পথ সুগম এবং মসৃণ ছিল না। কোনকালে পিচ পড়েছিল জানা নেই। রাস্তার ছাল চামড়া উঠে গিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথরের পথ বলাই ভালো। দেখলাম এই রাস্তার হাল ফিরতে চলেছে। একেবারে পাহাড়ি গ্রাম্য রাস্তা কেমন করে গাড়ি চলার উপযুক্ত হবে সেটাও একটা প্রশ্ন ছিল। চুইখিমের প্রবীণ মানুষ মণিকুমার ছেত্রীকে প্রশ্নটা করতে তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলাম সেটা ছিল ষাটের দশক। চার ফুট মাত্র চওড়া রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা ধরেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে গ্রামে রেশন পৌঁছে দিত ডিলারেরা। বলা যায়, ঘোড়া চলাচলের জন্যই প্রথম রাস্তা নির্মাণ। রেশনের চাল, গম, কেরোসিন তেল যেত গ্রামে। পঞ্চায়েতের উদ্যোগে পরবর্তীকালে রাস্তা চওড়া হলো। এরপর বাকি কৃতিত্ব বনদপ্তরের। ওদের উদ্যোগেই পিচের রাস্তা। দু পাশে ঘন জঙ্গল। যানবাহন চলাচল নেই বললেই চলে। চালক শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে থাকলেও পিছলে পিছলে যাচ্ছে।
পর্যটনের নয়া সার্কিট সফর চুইখিম
ঘন বনের মাঝখানে গাড়ি একটু সময়ের জন্য দাঁড়ালে প্রকৃতি নিরীক্ষণে মগ্ন হই। শাল, সেগুন কাঠের কত রকম পাঁচমিশালি গাছ। ময়না পাখিদের চেঁচামেচি। মনে হচ্ছে আমরা যেন অনধিকার প্রবেশ করেছি। টুই টুই শব্দে মাথার উপর শিমুল গাছের ডালে ছোট্ট পাখি ডাকছে। পাহাড় থেকে নেমে আসছে জিপে করে পাহাড়ি মানুষজন। দাঁড়িয়ে, বসে, ঝুলে যেমন খুশি যাচ্ছে শিলিগুড়িতে বা মালবাজারে। নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু কিনে আবার দিনের শেষে ফিরে আসবে। ডানদিকের পথ ধরে নদী, ঝোরা, খোলা পেরিয়ে পাথরঝোরার পথ। একাকী যাওয়া ঠিক নয়। হাতি না হলেও লেপার্ড এর মুখোমুখি হয়ে যাবার সম্ভাবনা। বেলা বারোটাতেই কেমন যেন আলো-আঁধারি পরিবেশ। তখন এগারোটি বাড়ির মালিকেরা হোম স্টে ব্যবস্থা চালু করেছিল। তাতে সব মিলিয়ে এক রাতে অন্তত তিরিশ জন পর্যটক থাকতে পারত। এখন সংখ্যাটা প্রায় পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম চুইখিম। গোটা গ্রাম যেন ঘুমিয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামতেই শীতল হাওয়ায় ক্লান্তি জুড়িয়ে গেল। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা নেই। তবে হাল্কা গরম বস্ত্র না চাপালেই নয়। এখানে বেশ ঠান্ডা। চুইখিমের বেশ কিছু বাড়িতে গ্রামীণ পর্যটন বা হোম স্টে চালু হয়েছে। শহুরে আরাম-আয়েশ না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্যে ত্রুটি কিছু নেই। অতিথি সেবার জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের আন্তরিকতায় ত্রুটি নেই। আমরা উঠেছিলাম নরেশ গুরুং এর হোম স্টেতে। এটা এখন হামরো হোমে পরিণত হয়েছে। গ্রামে হোম স্টে র মালিক পবিত্রা খাওয়াস, দুর্গা গুরুং, নরেশ গুরুংরা ঝুম চাষের বাইরে অন্য রোজগারের পথ পেয়ে খুশি। গাছের ছায়ায় সবুজ নরম ঘাসে পদ্মাসন করে বসা যায়। সামনে ধ্যানমগ্ন সবুজ পাহাড়। বুকের খাঁচায় ভরে নেওয়া যায় তাজা অক্সিজেন। নেই বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ এবং রাজনৈতিক ডামাডোল। আছে ন্যাচারাল ঝর্ণার জল, বিশুদ্ধ বাতাস, পাখির কুজন এবং চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত থাকার আনন্দময় জগত। পাখি দেখার নেশা থাকলে দূরবীন, নোটবুক এবং পাখি চেনার বই নিয়ে মাসের-পর-মাস কাটাতে পারা যায়। রক ক্লাইম্বিং তো বটেই, জঙ্গলের চারপাশে সারাক্ষণ কাটানো যায়। স্থানীয় ছেলেরাই পথপ্রদর্শক সামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে। ইচ্ছে হলে ভিলেজ জঙ্গল সাফারিতে অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। নেপালি নাচ গানে আগ্রহ থাকলে নতুন এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে। এখানকার মহিলারা যেসব কুটির শিল্প তৈরি করেন সেই সব কেনা যায় এবং পরামর্শ দেওয়া যায় নতুন কিছু করার। পর্যটকেরা যে কালিম্পং বা লাভা ছেড়ে তাদের গ্রামে আসতে পারেন তা তারা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবতে পারেন নি। মাত্র দুই ঘণ্টায় চুইখিম থেকে লোলেগাঁও যাওয়া যায় বলে পর্যটনের এক নতুন রুট হয়ে উঠতে পারে এই চুইখিম।
লিম্বুগ্রামের শতায়ু বিন্দ্রা মায়া ছেত্রীর সান্ন্যিধ্যে
সকাল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। উথাল-পাথাল বাতাসে কাঁপছে চুইখিমের দিক দিগন্ত। আবহাওয়া খারাপ বলে সেদিন ঘরের বাইরে যান নি বিন্দ্রা। বিন্দ্রা মায়া ছেত্রী। আমি বসে আছি বিন্দ্রা মায়া ছেত্রীর সামনে। ঠিক কত সালে জন্ম সেটা তার নিজেরও মনে নেই। ছেলেপুলে, নাতি-পুতির বয়স হিসেব করে জানা গেল সেঞ্চুরি পেরিয়ে গেছে। নেপালি ছাড়া আর অন্য কোন ভাষা জানে না বিন্দ্রা । উত্তরবঙ্গের এই একটি গ্রামে শতবর্ষ পার করা বিন্দ্রা মায়া ছেত্রীই শুনিয়েছিলেন এই গ্রাম গড়ে ওঠার ইতিহাস। না এতটুকুও বাড়িয়ে বলছি না। উনি ছাড়া যারা বলতে পারতেন তারা কেউ বেঁচেও ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই নাতি কিরণ কথকতায় দোভাষীর ভূমিকা পালন করে। আর ছিলেন অজন্তাদি। দন্তহীন এক অমলিন হাসি দেখা বিন্দ্রার। বাড়ির লোকেরা জানালো বিন্দ্রা সারাদিন ঘরের বাইরে কাজ করে। শুধু বৃষ্টি হলে ঘরবন্দি। রান্নাঘরে কাঠের উনানের সামনে বসেই দিনটা কাটবে তার। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুতে যান। কান এবং চোখ দুটোই প্রায় জবাব দিয়েছে। স্মৃতি সারা দেয় রীতিমতো যুদ্ধ করে। তবুও মহা উৎসাহে সব কথার জবাব দেবার চেষ্টা করে। ছেলের ঘরে মেয়ে, সেই মেয়ের মেয়ে হবার পর তার ঘরেও ছেলে এসেছে। বয়সের গাছ পাথর আর থাকে কি করে? স্মৃতি তো বিদ্রোহ করবেই। চুইখিমের শুরুর দিনগুলো জানতে তার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত পর্যটন সংস্থা হেল্প টুরিজমের অন্যতম সংগঠক রাজ বসু সহ বিভিন্ন পরিবেশ পর্যটন নিয়ে যারা কাজ করে তাদের প্রচেষ্টাতেই চুইখিমের গড়ে ওঠার ইতিহাস। তাদেরই সার্থক উত্তরসূরী অজন্তা বিশ্বাস। চুইখিমের এইসব পাহাড়ি মানুষদের নিয়ে কাজ করছেন, সাস্টেনেবল টুরিজম নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছেন। পেশায় সাংবাদিকতা, নেশাতে মানবসেবা, শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করা। এক অদ্ভূত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।
লিম্বুগ্রাম চুইখিমের সাতকাহন
উত্তরবঙ্গের যে কোন গ্রামের থেকে চুইখিমের ইতিহাস তেমন আলাদা কিছু নয়। এখানকার প্রকৃতিতে আছে পর্যটক আকর্ষণ করার অসীম ক্ষমতা। একটি অঞ্চলের উন্নয়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অজন্তাদির কাছ থেকে জেনেছিলাম এলাকায় রত্ন বাহাদুর গুরুং প্রধান হিসাবে পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পালন করেন দু’বার ২০০০ সাল পর্যন্ত। ২০০০-২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রধান ছিলেন ইসতার লেপচা নামে একজন মহিলা। তখন থেকে উন্নয়নের সূচনা। তবে ২০০৫ সালের পর আর পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়নি। এতে গ্রামের মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে চিন্তাভাবনার দায়িত্বটা যথাযথ পালিত হতে পারছে না। চুইখিম, ইয়েলবং, নবগাঁও, শেরওয়ানি, বাগড়াকোট, ভাঙ্গা, বরবটি, রাতো গ্রামগুলি নিয়ে গঠিত হয় পবরিংটার গ্রাম পঞ্চায়েত। উন্নয়নের কাজ বেশ কিছুটা হয়েছে। পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে রাস্তা হয়েছে। জলের সংযোগ পেয়েছে গ্রামবাসী। চাষবাসের জন্য ঋণও মিলেছে। যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো উন্নয়নের প্রশ্ন। চুইখিমের কিছু কিছু অঞ্চলে জলের তীব্র সমস্যা আছে। নতুন রাস্তা সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। পুরনো রাস্তাগুলিকে সারাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। গ্রামের পথঘাট, স্কুল ইত্যাদি থেকে উৎসব উদযাপন সবকিছুই গ্রামবাসীদের ব্যাক্তিগত উদ্যোগ এবং কিছু এনজিওর সহযোগিতায় হচ্ছে। নদীর অববাহিকা এবং পর্বতশ্রেণীর আলিঙ্গণে অপরূপ ছবি আঁকা যায়। ইদানিং পর্যটকেরা যথেষ্ট আকৃষ্ট হচ্ছেন। তবে রাস্তার সমস্যাটা এক্ষেত্রে অন্তরায়। আর এক সমস্যা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং টেলিফোন নেটওয়ার্ক। যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাচীনতা, পথঘাট আর আধুনিক ইন্টারনেট সব ক্ষেত্রেই সরকারি-বেসরকারি আনুকূল্যের বাইরে। তবুও শান্ত নির্জন এই গ্রামে আসেন পর্যটকেরা।
নেপালী এবং লিম্বু অধুষিত গ্রাম চুইখিম
জানলাম চুইখিমে সবাই সবার সঙ্গে মেলামেশা করে। পূজা-পার্বণে সবাই সবাইকে ভালোবাসে। একসঙ্গে একে অপরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এর ফলে গ্রামের সামাজিক জীবন, রীতি রেওয়াজ এবং পুজো পার্বণ সেই প্রেক্ষিতে হতে থাকে। দুর্গাপুজো হয় ধুমধাম করে। সেখানে ভোগ নিবেদন আবশ্যক। কালী পুজো হয়, সঙ্গে ভাইটিকা। এটা পারিবারিক মহোৎসব বলা যায়। চুইখিমের কোন মানুষকে সেদিন কোন কাজে পাওয়া যাবে না। পয়লা বৈশাখেও বেশ জমজমাট অনুষ্ঠান হয়। বড়দিনে খ্রীষ্টানরা এবং বুদ্ধ জয়ন্তীতে বৌদ্ধদের উৎসব উদযাপিত হয় চুইখিমে। বিগত দিনে উৎসবের এত রমরমা ছিল না। গ্রামে লোকজন বেড়েছে। ব্যাস্ততাও বেড়েছে। তাই উৎসবের ঘনঘটা কমেছে। অনুন্নয়নের জন্য খুব বেশি ক্ষোভ বা অভিযোগ কিন্তু শোনা যায় না। এখানকার মানুষের চরিত্রে যেন এই রাগ অভিমান বা ক্ষোভের ব্যাপারটা নেই যে প্রবণতা জন্মগতভাবেই চলে আসছে। বড়ই অল্পে খুশি ওরা। দেশের নাগরিক হিসেবে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার অধিকার যে সকলের আছে সেটা ওরা এই জীবনে ভেবে উঠতে পারল না। মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে অনেক কথা শুনি আমরা। কিন্তু চুইখিমের মত পরিশ্রমী, প্রাণপ্রাচুর্যে উজ্জ্বল শৈশব, কৈশোর এবং তারুণ্য দেখে মনে হয়নি কেউ ওদের কথা ভাবে। চুইখিমের প্রবীণা বৃদ্ধা বিন্দ্রার পরিবারের কাছ থেকে জানলাম বিয়ের পর একেবারে অসময়ে হঠাৎ করে স্বামী যখন গত হলেন তখন বিন্দ্রা দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাস করতেন নেপালে। বড় দাদার সহযোগিতায় কিছুদিন ভুটান হয়ে শেষে এসে পৌঁছালেন চুইখিমে। সেই মাটির টানেই আশ্রয় নিলেন চুইখিম গ্রামে। চাষবাস এর উপর ভরসা করে ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু করলেন নতুনভাবে জীবনযাপন। একদিকে সন্তান এবং অন্যদিকে জঙ্গল ও প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে টিকে থাকার রণক্ষেত্র। লড়াই জারি থাকলেও নেপালে ফসল ফলানোর কোন উপায় ছিল না। কারণ জমি ভালো ছিল না। নেপাল থেকে চুইখিম নেমে আসার পর তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে ধীরগতিতে।
জঙ্গলের সঙ্গেই শুরু চুইখিমের গড়ে ওঠার যুদ্ধ
আর্থিক অনগ্রসরতা নিয়েই হাসিখুশি জনজীবন চুইখিমে। স্বাধীন মহকুমা কালিম্পং স্বাধীন জেলার স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে পর্যটনকে পটভূমিতে রেখে জেলার এইসব পাহাড়ি ছোট ছোট গ্রামগুলোর ভাগ্য নির্ধারিত হয় সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে। আর্থিকভাবে যথেষ্ট অনগ্রসরতা তো আছেই, এরই সঙ্গে সচেতনতার অভাব, শিক্ষাক্ষেত্রে চরম প্রতিকূলতা, দূর্গম পথে যানবাহন চলাচলের সমস্যা প্রতিমুহূর্তে উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামগুলির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান এর মাত্রা একেবারে নিচের দিকে। কারণ পাহাড়ে ভারী শিল্প গড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ নেই। চাষবাস অর্থ উপার্জনের উপায়। এক্ষেত্রে কিছুটা উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পেলে মানুষগুলি আর্থিক স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারেন। স্বাধীনতার এতগুলি বছর পরেও ব্যাপকহারে বিষয়টা চোখে পড়ে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার পরিস্থিতি প্রায়ই থাকে না তাদের। তবুও এদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন। লিম্বুগ্রাম চুইখিমে তিনটি প্রাইমারি স্কুলের পাশাপাশি একটি জুনিয়র হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে কিছু মানুষের উদ্যোগেই। শিক্ষার উন্নতিতে এই উদ্যোগ পর্যাপ্ত না হলেও উল্লেখের দাবি রাখে। এমনই একজন মানুষ ছিলেন গ্রামের প্রাক্তন এক পঞ্চায়েত যার নেতৃত্বে পঞ্চায়েতের উদ্যোগে গ্রামে জল সরবরাহের কাজ শুরু হয়েছিল। পঞ্চায়েতের সদস্য হিসেবে গ্রামের সুবিধা-অসুবিধা দেখায় তাঁর নাম আজও গ্রামের অনুপ্রেরণা। গ্রামে জুনিয়র হাই স্কুল নির্মাণ করে আপাতত চুইখিমের পাশাপাশি আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। কিছু দূরের বাগরাকোট হাইস্কুল বাদ দিলে অঞ্চলের এটাই প্রথম হাই স্কুল। দেখলাম এখনও স্কুল সরকারি অনুমোদন পায়নি। আর্থিক প্রতিকূলতা যথেষ্টই।
চুইখিম গ্রাম গড়ে ওঠার প্রেক্ষিত
হামরো হোমের মালিক নরেশ গুরুঙ্গের সঙ্গে গেলাম গ্রাম সফরে। গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে ছবির মত পাহাড়ি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে চুইখিম সমুদয় বিকাশ সমিতি। দেখলাম সেখানে লিম্বুদের আধিপত্য বেশি। এই গ্রামের প্রায় সবাই গোর্খা, তামাং, লিম্বু সম্প্রদায়ভুক্ত। বেশ কয়েক ঘর লেপচা এবং ভুটিয়া থাকলেও থাকতে পারে। এখনো এই অঞ্চলের মানুষজন সহজ সরল।চুইখিম সমুদয় বিকাশ সমিতির সদস্য চুইখিম গ্রামের বেশ কিছু প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। প্রবীণ সদস্য মণিকুমার ছেত্রীর জন্ম এই গ্রামে। তাই চোখের সামনে পরিবর্তনটা দেখেছেন। এখন ৬৬ বছর বয়স। অত্যন্ত কর্মঠ। তাঁর এবং প্রবীণদের অন্তর্কথাতে যেটা জানলাম সেটা হল মণি দাজুদের ছোটবেলায় চুইখিমের এই অঞ্চলের পুরোটাই তখন ছিল জঙ্গল। এই অঞ্চলটা ছিল পুরোপুরি বনদপ্তর এর অধীনে। অর্থাৎ সরকারের খাস জমি। সেখানে বসবাস শুরু করে তাঁরা। তবে মাটি বড় ভালো ছিল। শুধুমাত্র চাষ ভালো হতো বলেই জীবন জীবিকার কারণে বসবাস। ঘন জঙ্গল একদিকে। সেখানে লেপার্ড, বাঘ, ভালুক, শুয়োর এবং বাঁদর ছিল। তারা হামলাও করত। গরু বাঁচানো মুশকিল হত খুব। অন্যদিকে লিস নদীর মাঝের উপত্যকায় অতি উর্বর জমিতে ধান, ভুট্টা, বিভিন্ন সবজি চাষ, স্ট্রবেরি, পেয়ারা, কলা ইত্যাদি ফল চাষ হত এবং এখনো হয়। সেই সময় ছিল খুব বেশি হলে আঠারোটা ঘর। সেই অল্প ঘরের অল্প মানুষদের নিয়ে জঙ্গলের সঙ্গে শুরু হলো চুইখিমের গড়ে ওঠার যুদ্ধ। চুইখিমের যুদ্ধ জঙ্গলের হিংস্র পশুর সঙ্গে এবং লড়াই অচেনা প্রকৃতির বিরুদ্ধে। প্রবল ঠান্ডা, বর্ষায় ঝড় বৃষ্টির প্রকোপ। উচ্চতা মাত্র ৩৫০০ ফুট হলে কি হবে, চারপাশে বিস্তৃত পর্বতশ্রেণী, দুই পাশে দুই নদী আর একদিকে ঘন জঙ্গল যেমন হিংস্র পশুর আধিপত্য ত্বরান্বিত করেছে, তেমনি প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঘনঘটাও দিয়েছে লড়াই করার শক্তি। ফসল ফলানোই একমাত্র বাঁচার উপায়। তখন শাকসবজি না জন্মালে খাওয়া জুটবে না। আসলে তখন প্রকৃতির সঙ্গে জঙ্গলের লড়াইটা মুখ্য ছিল। অতি পরিশ্রম এবং যত্নে লালিত ফসল রাতারাতি কে বা কারা নষ্ট করে চলে যেত। বন থেকে আসা জানোয়ারের দল, ভালুক, বাঁদর, শুয়োর। সবই ছিল সে বড় কষ্টের দিন। তবে লড়াই থামেনি।
অল্পেই খুশি এবং তৃপ্ত চুইখিমের জনজীবন
চাষবাস এখানকার মানুষের জীবিকা। জঙ্গল কেটে বসত হয়েছে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চুইখিমের বাসিন্দারা। তবুও অর্থ কষ্ট দূর হয় না। আজও গ্রামে কোন চিকিৎসা কেন্দ্র নেই। একজন ডাক্তার বসেন এখানে। এর বাইরে চিকিৎসার জন্য গ্রামের মানুষের ভরসা মালবাজার। আলু, শাকসবজি, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য জরুরি উপকরণ কিনতে হবে বাগরাকোট থেকে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর সোমবার করে রেশন মেলে। চাল গম এবং কেরোসিন তেল। ব্যাংক এবং এটিএম এখানে নেই। বহু দশক পার হয়ে যাবার পরেও চুইখিমের প্রাপ্তিযোগ খুব একটা বেশি কিছু হয়নি। এখানে বাঁশ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও বাঁশের তৈরি জিনিস ঠিকমতো প্যাকিং করার ব্যবস্থা না থাকায় বাঁশের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ একসময় এখানে বাঁশের কাজের একটা চর্চা কেন্দ্র ছিল। এখন কয়েকজন মাত্র বর্ষিয়ান মানুষ এটাকে টিকিয়ে রেখেছেন। শ্রমজীবী মানুষ বা কৃষির পাশাপাশি মিস্ত্রি বা মজুরের কাজ করেও জীবন ধারণ করেন অনেকে। চুইখিম পাহাড়ে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে স্থানীয় বাসিন্দারা সন্ধ্যার পর খাওয়া-দাওয়া সেরে যে যার মত শুয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়ে পড়া ছাড়া রাতের অন্ধকারে করার কিছু নেই। কারণ শেষ রাতে উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করতে হয় গ্রামবাসীদের। গরু, বাছুর, মুরগি, শুয়োর পালন, শস্য ক্ষেতে যাওয়া সব কিছুর মধ্যে এক বাঁধাধরা ছন্দ। সরকারিভাবে বন্ধ কয়লাখনি থেকে লুকিয়ে কয়লা তোলে। চাষ-বাস এর বাইরে কিছু মানুষ ড্রাইভারি করেন। বনদপ্তর এর কাজ করেন কেউ কেউ। সেনাবাহিনীতেও যান। তবে সে তো সংখ্যায় অতি সামান্য। আয় ব্যয়ের হিসাব করতে গেলে দেখা যাবে সঞ্চয়ের ঘর শূন্যের কোটায়। প্রবীণরা ভাবেন তাঁদের দিনটা কেটে গেলেই যথেষ্ট। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চুইখিম গ্রামে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করেছে এবং এখনো করছে। টিমের নতুন সময়ের প্রতিনিধি যারা, তারা কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। বিশেষত স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে কাছাকাছি হবার সুযোগ থেকে দেখেছি কত সহজে কম উপকরণে ভালো থাকে ওরা। সামান্য কিছু উপহার হাতে পেলে আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শিশু এবং কিশোর মুখগুলি। খুশি এবং তৃপ্ত থাকাটাও এদের জীবনের একটা বড় শিক্ষা। খেলাধূলায় অনেকেই বেশ ভালো। কিন্তু সুযোগ কোথায়? চুইখিম থেকে ওদলাবাড়ি এইটুকুই পৌঁছতে পারে না অনেকে। এই কারণে কোথায় যে ওরা বঞ্চিত সেটা বোঝার অবকাশ থাকে না।