সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
02-December,2022 - Friday ✍️ By- সুব্রত ভট্টাচার্য 450

শিলংয়ের হাতছানি/সুব্রত ভট্টাচার্য

শিলংয়ের হাতছানি
সুব্রত ভট্টাচার্য
================

স্কুল ছেড়ে সবে কলেজে পা রেখেছি। হঠাত শিলংয়ের ডাক এসে গেল। শিলং যাবার একখানা নিমন্ত্রণ পেলাম। বন্ধু প্রশান্তর বাবা সেনা বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরে চাকরি করেন। শিলংয়ে বদলি হয়েছেন বছর খানেক আগে। প্রশান্তর কাছেই শহরের বর্ণনা শুনলাম। তার সাথেই যাবার নিমন্ত্রণ। বাড়ির সম্মতি পাওয়া গেল সহজেই।
নিজের শহরের বাইরে তখন খুব বেশি জায়গা দেখা হয়নি। একটু দূরে যাবার আনন্দে মনটা নেচে উঠল। দিনক্ষণ দেখে রিজার্ভেশন হল। আমরা রওনা হলাম শিলংএর উদ্দেশ্যে। অক্টোবরের শেষ দিক। শীতবস্ত্র নেওয়া হল পরিমাণ মতো। আসাম মেল-এ শিলিগুড়ি থেকে গুয়াহাটী তারপর বাস ধরে গুয়াহাটী থেকে শিলং। বিস্তর খোঁজ খবর নেওয়া হল। সেগুলি সব ছোট ডায়েরিতে লিখে নিলাম।
রাতভর জার্নি করে ভোর বেলা পৌঁছেছি গুয়াহাটি। পাশেই পল্টনবাজার বাস স্ট্যান্ড। হাত মুখ ধুয়ে, এক কাপ চা খেয়ে টিকিট কেটে আমরা তৈরি। বাস আসতেই সীট নম্বর দেখে বসে পড়লাম। সময়মতো ছেড়ে দিল বাস। কিছুটা শহরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে তারপর শহর ছেড়ে বাস বাইরে বেরিয়ে এলো। দুপাশে অনেক গাছ, কালো পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে বাস। কোথাও রাস্তা উঁচুনিচু কোথাও বা মসৃণ। মাঝে মাঝেই আঁকাবাঁকা।
আরও খানিকক্ষণ চলার পর শুরু হল পাহাড়ি রাস্তা। বাস ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। রাস্তার পাশে মানুষজন কম। বেশ খানিকক্ষণ বাদে বাদে ছোট ছোট জনপদ দেখা যাচ্ছে। দুপাশে তাকালেই নজর পরে গাছগাছালি আর পাহাড়।
ঘন্টা দেড়েক চলার পরে এক জায়গায় বাস থামল। জায়গার নাম ‘নংপো‘। এখানে চা খাবার বিরতি। অন্যান্য যাত্রীর সাথে আমরাও নেমে পড়লাম। আরও চার পাঁচটা বাস এবং কিছু গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কটা রেস্টুরেন্ট। কিছু যাত্রী চা পানে ব্যস্ত। টয়লেটের সামনেও লম্বা ভিড়। যাই হোক টয়লেট ব্যাবহার করে হাত মুখ ধুয়ে আমরাও চা আর হাল্কা খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর আবার বাসে উঠে পড়লাম।
একটু অপেক্ষা করে দু বার হর্ন বাজিয়ে বাস আবার যাত্রা শুরু করল শিলংয়ের উদ্দেশ্যে। এবারে চড়াই একটু বেশি। গোঁ গোঁ শব্দ করে বাস ক্রমশঃ উঠছে পাহাড়ে। মাঝে মাঝেই বাঁক নিচ্ছে ডানদিক, বাঁদিক। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে গাছপালা আর পাহাড়। আর মাঝে মাঝে বাড়িঘর। কখনও দেখা যাচ্ছে ওপরের রাস্তা কখনও দেখা যাচ্ছে নীচের ফেলে আসা রাস্তা।
শিলং পৌছুনোর কিছুক্ষণ আগে বরাপানিতে রাস্তার পাঁশে দেখা গেল উমিয়াম লেক। অসাধারন সে দৃশ্য। এ জায়গা থেকে শিলং শহর পনেরো কিলোমিটার। লেক পেছনে রেখে বাস চলতে থাকল শিলং-এর দিকে। এখন পাহাড়ের গায়ে বেশ কিছু বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মানুষজন, বাজার, জনপদ। বোঝা যাচ্ছে আমরা শহরের কাছাকাছি এসেছি। বাস চলছে পাহাড়ি পথ বেয়ে। পাহাড়ি পথে যাত্রা করতে অনেকেরই একটু অসুবিধা হয়। আমি আর প্রশান্তও তার ব্যতিক্রম নই। একটু অস্বস্তি হচ্ছে।
আমরা ধীরে ধীরে শহরের মধ্যে প্রবেশ কলাম। বাস এসে পৌঁছুল শহরের মাঝখানে পুলিশ বাজার বাস স্ট্যান্ডে। যাত্রীদের সাথে আমরাও নেমে পড়লাম জিনিসপত্র নিয়ে। বেশ ঠান্ডা লাগছে। এবারে আমাদের বাড়ি খোঁজার পালা।
কাকাবাবু চিঠিতে বিস্তারিত লিখে দিয়েছিলেন। সে নিয়ে আমরা যথেষ্ট হোম ওয়ার্কও করেছিলাম। সেভাবেই কাছাকাছি সিটি বাস স্টপ থেকে বাস ধরে লাইমোখ্রা স্টপেজে পৌঁছালাম। তারপর খানিকটা পথ নেমে এবং উঠে একেবারে অফিসের গেটে পৌঁছালাম। রক্ষীদের কাকাবাবুর নাম বলতেই একেবারে মেসের দরজা অবধি পৌঁছে দিলেন।
আমরা পৌঁছুলাম, তখন দুপুর দুটো। কাকাবাবুও খবর পেয়ে এসে গেছেন অফিস থেকে। ছেলে এবং তার বন্ধুকে পেয়ে ভীষন খুশি। সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তখন শরীর বেশ ক্লান্ত। স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা কম্বলের নীচে ঢুকে পড়লাম।
সন্ধ্যায় কাকাবাবুর সহকর্মী কয়েকজন আমাদের সাথে দেখ করতে এলেন। কাকাবাবুর মুখ থেকে আমাদের গল্প শুনেছেন তারা। রাত বাড়তেই শীত বোঝা গেল। সাড়ে নটায় খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা আবার কম্বলের নীচে ঢুকে পড়লাম।
পরদিন সকালে একটু বেলা বাড়তেই শীতের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আমরা বাইরের এলাকাটা দেখতে বের হলাম। ঘরের আশেপাশে অনেক রকম ফুলের বাগান। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘরবাড়ি। সামনে দাঁড়ালে উল্টোদিকের পাহাড় দেখা যায়। কোথাও রাস্তা কোথাওবা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা যায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এলাকা। মাঝে মাঝে পাইন আর অন্য গাছের সারি। হাওয়া বলে শন শন শব্দ ছড়িয়ে পড়ে।
**** **** **** ****
কাকাবাবুর অফিস সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত। মাঝে সাড়ে বারোটায় আধ ঘন্টার টিফিন পিরিয়ডে ঘরে আসেন। আমি আর প্রশান্ত এখন মেসের নিয়মিত মেম্বার। সকাল সাড়ে সাতটায় বিছানার পাশেই টেবিলে বেড টি মেলে। সাড়ে আটটায় ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট আর চা। দুপুর একটায় দুপুরের খাবার আবার রাত নটায় রাতের খাবার।
দিনের বেলা আমি আর প্রশান্ত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। কাকাবাবু বলে দিয়েছেন – বাইরে বের হলে আইডেন্টিটি কার্ড সাথে রাখতে। ক্যাম্পাসে কিছু এলাকাতে সাধারণ মানুষ যাবার অনুমতি নেই। কোথাও নোংরা ফেলা যাবে না। আমরা সেভাবেই ঘোরাফেরা করি।
অফিস ছুটির পর অথবা ছুটির দিনে আমরা কাকাবাবুর সাথে ঘুরে বেড়াই। কখনও শহরে কখনও তার সহকর্মীদের বাড়িতে। অনেক পরিচিতদের বাড়িতেই আমাদের দুপুরের বা রাতের আহার সারতে হল। তাদের আতিথেয়তা সত্যিই মনে রাখার মতো। আমাদের ঘোরা হয়ে গেল পুলিশ বাজার, বড় বাজার, ওয়ার্ডস লেক, লাবান, উমপ্লিং, রিলবং। দেখা হলো জলপ্রপাতগুলি এলিফেনট ফলস, বিডন, বিশপ ইত্যাদি। একদিন চলে গেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত “জিতভূমি” বাড়িটি দেখতে। কবিগুরু এখানে এসে বেশ কিছুদিন ছিলেন। একটি আবক্ষ মূর্তি কিছুদিন আগে স্থাপন করা হয়েছে।
মেঘালয় রাজ্যের তিন প্রধান উপজাতি সম্প্রদাদায় হলো খাসি, জয়ন্তিয়া এবং গারো সম্প্রদায়। শিলংয়ে খাসি সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি। অন্যান্য অনুপজাতীয় মানুষও আছেন অনেক। অধিকাংশ মানুষ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। বিভিন্ন জায়গাতে বড় বড় গির্জা রয়েছে। নিয়মিত প্রার্থনা হয় এই সব গির্জা ঘরে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বড়দিন আর ইংরেজী নববর্ষে সারা রাজ্য উৎসবে মেতে ওঠে।
শিলংয়ে পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষনের জায়গা হলো পুলিশ বাজার, ওয়ার্ডস লেক, লেডী হায়দারী পার্ক, ডন বস্কো মিউজিয়াম, ক্যাথিড্রাল চার্চ, এলিফেন্ট, বিডন, বিশপ, এস ই ফলস, এয়ার ফোর্স মিউজিয়াম, গলফ কোর্স ফিল্ড, মাতৃ মন্দির কালীবাড়ি, শিলং পিক, ক্যাপ্টেন সাংমা স্টেট মিউজিয়াম ইত্যাদি। পুলিশ বাজার অঞ্চলে প্রচুর হোটেল ও দোকান রয়েছে। এখানে মেঘালয়ের অনেক রকম হস্তশিল্প, স্থানীয় চাদর ইত্যাদি পাওয়া যায়। শহরের থেকে বাইরে রয়েছে চেরাপুঞ্জী, উমিয়াম লেক, ডাউকি বর্ডার। শহরের ভেতরেই ওয়ার্ডস লেক আর তার কাঠের ব্রিজ অসাধারন সুন্দর। ডন বস্কো এবং স্টেট মিউজিয়ামে গেলে মেঘালয়ের এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতি মানুষের পোষাক, জীবনযাত্রা সম্বন্ধে সুন্দর ধারণা পাওয়া যায়।
মেঘালয় রাজ্য তৈরি হবার আগে অবিভক্ত অসমের রাজধানী ছিল শিলং। সেজন্য এখানকার রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বেশ উন্নত। শহরে সবুজায়ন বর্তমানে খানিকটা কমলেও এখনও প্রচুর গাছপালা রয়েছে। শহরের লাবান, উমপ্লিং, রিলবং, জেল্ রোড অঞ্চলে অনেক বাংলাভাষী পরিবার রয়েছেন। অন্যান্য অঞ্চলে অনুপজাতীয়দের ঘরবাড়ি কেনায় বিধিনিষেধ রয়েছে।
শিলংয়ে বহু পুরোনো কিছু বাংলাভাষী পরিবার রয়েছেন। তাদের পরিবারের মানুষেরা স্বাধীনতার আগে থেকেই এখানকার বাসিন্দা বা ঠিক পরে এখানে এসেছেন। রাজ্যের বহু দুর্গম জায়গায় তারা চাকরি করতেন। রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণে, জল এবং বিদ্যুৎ সরবরাহে, তাদের অবদান স্মরণে রাখার মতো। বর্তমানে অনুপজাতীয় মানুষদের চাকরি এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ কমে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম তাই প্রিয় শহর ছেড়ে কলকাতা, দিল্লী, বাঙ্গালোর, পুনেতে পাড়ি দিচ্ছেন।
প্রায় কুড়ি দিন শিলংএ থাকবার পর আমাদের ফেরার সময় এসে গেল। কিছু মানুষ এবং পরিবারের সাথে অল্পদিনে ভীষণ সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাদের বিদায় জানাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। বিদায় জানাতেই হলো, বিদায় জানিয়ে আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। বাসে গুয়াহাটি তারপর ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি পৌঁছালাম। শিলংএর স্মৃতি এবং উত্তরপূর্বের বাংলাভাষী মানুষদের আতিথেয়তা এবং আন্তরিক ব্যবহার মনে স্থায়ী হয়ে রইল। এর পরেও বেশ কবার শিলংএ যাবার সুযোগ হয়েছে। গ্রীষ্মকালে সমতলে যখন মানুষ গরমে নাজেহাল তখন সবুজের মাঝে সুন্দর এই আধুনিক শহরে কদিনের ছুটিতে ঘুরে আসতে বেশ ভালোই লাগে।
**** **** **** ****
ছবি ঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ।
ছবি (১)- উমিয়াম লেক, (২)- এলিফেন্ট ফলস, (৩) – ডনবস্কো মিউজিয়াম, (৪) ওয়ার্ডস লেক, (৫)- ওয়ার্ডস লেক, (৬)- শিলং পিক থেকে দেখা শহর, (৭) গুয়াহাটি শিলং সড়কপথ ।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri