মেঘের দেশে মেঘ পাহাড়ে/টিপ্ লু বসু
মেঘের দেশে মেঘ পাহাড়ে
টিপ্ লু বসু
====================
"তোমার হাতের মাঝে আছে পর্যটন -----'
একথা কি খুশি করে মন ?
একথা কি দেশ ঘুরে আসে
স্মরণীয় বসন্তবাতাসে"
সমস্ত পর্যটনই খুশি করে মন, হাতের মাঝে কিংবা চরণের গতিতে। মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে যদি একদিন পৌঁছে যাওয়া যায় মেঘেদের আলয়ে ---- এক স্বপ্নের দেশে ----- তাহলে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দে বুকের ভেতর দুলে ওঠে মোরগ ঝুঁটি! তেমনটাই তো ঘটে গেল ক'দিন আগে। হঠাৎই আমাদের তিন অসমবয়সী বান্ধবীর বুকের ভেতর একসঙ্গে বেজে উঠলো 'যাই'! কোথায় যাব? কেন,--- মেঘেরা ডাকছে, তাদের দেশে ডাকছে, 'মেঘালয়' হাতছানি দিচ্ছে তার সৌন্দর্যের ডালি উজাড় করে। অতএব রাতের ট্রেনে চেপে 'চলো গৌহাটি'।
সকালে স্টেশনে নেমে লাইনে দাঁড়িয়ে কোভিড টীকাকরণ সার্টিফিকেট দেখিয়ে গেটপাস যোগাড় হল অহম প্রদেশে প্রবেশের। দিলীপ মোহন্ত আমাদের সফর-চালক তার শকটসহ প্রস্তুত। পথে প্রাত:রাশ সেরে যাত্রা শুরু। আমরা চলেছি মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। শিলং ঢোকার আগে আবার গেটপাস যোগাড় করতে হল। অবশেষে শিলংপাহাড়। মেঘের নিত্য আনাগোনায় নীল আকাশ আরো নীলাভ , পাহাড়ের সবুজ আরো সতেজ সুন্দর, পাইন বনের সারি পাখির কূজন-মুখরিত, উমিয়াম হ্রদের স্থির জলে পাহাড়-জঙ্গলের স্নিগ্ধ ছায়া। রূপে তো বটেই ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলো অমিত-লাবণ্যর ভালোবাসার শহর। রবীন্দ্রনাথ 'শেষের কবিতা' লিখেছেন যে 'ব্রুকসাইড ভিলা'য় বসে ও 'রক্তকরবী' লিখেছেন যে 'জিৎভূমি' নামক বাড়িটিতে সে দুটি দেখে আপ্লুত হলাম আমরা।
পরদিন সকালে ডাউকি বা দৌকি নদীর জন্য বেরিয়ে পড়া। শিলং থেকে ৮৩ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে অপরূপ পার্বত্য সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মুগ্ধতার অপরিসীম সার্থকতায় জারিত হয়ে ডাউকি নদীর তীরে পৌঁছলাম। ডাউকি নদীতে বোটিং অনবদ্য এক পার্থিব অভিজ্ঞতা। অবাক করা রূপ মেঘালয়ের এই নদীর। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল। মনে হয় যেন কাচের ওপর রয়েছি, glass bottom river , একঝলকে নদী বলে বিশ্বাস করাই কঠিন। এশিয়া মহাদেশের স্বচ্ছতম এ নদীতে কেবল নৌকাটির ছায়া পড়ে তলদেশে। এটি উমনগোট নামেও পরিচিত। Cleanest village মৌলিননঙ্গ গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়েছে নদীটি। শিলং মালভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়েছে এটি। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং দিয়ে নদীটি বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করেছে। জলের তলার নুড়িপাথরগুলির বর্ণবৈচিত্র্য ও মাছেদের সাঁতার দেখতে দেখতে জলের রঙের ছটা আমাদের ভেতর এক অপার মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে। দূষণমুক্ত হওয়ার কারণেই ১৫ ফুট গভীর নদীটি এই স্বচ্ছতা অর্জন করেছে --- এমনই মত পরিবেশবিদদের। নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতুটি ১৯৩২ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে জয়ন্তিয়া ও খাসি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত এই নদী। দুদিকেই এটি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য। হাজার হাজার পর্যটক এখানে ভীড় জমান। বর্ষাকালে শিলা পরিবহণে এই নদীস্রোত বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ডাউকি-তামাবিল সীমান্ত দিয়ে এই নদী কয়লা পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এ এক স্বচ্ছ-সূক্ষ্ম ভ্রমণ। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত স্বচ্ছ নদীর শেষে জলপ্রপাতের কাছে নৌকা এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। অকৃপণ দানে প্রকৃতি সমৃদ্ধ করে আমাদের। অপার ঋণজালে জড়িয়ে যেতে যেতে প্রণামের দুই হাত আপনিই উঠে আসে রূপ-অরূপের অপূর্ব মিলনের প্রতি। দাঁড় বেয়ে চলা খাসি যুবকের ঘামে ভেজা শরীরে মিশে যায় নদী ও পাহাড়ের অনাবিল নির্যাস। স্বচ্ছ ও সুন্দর হয়ে ওঠে অন্তরের অন্দর। ফিরে আসাও যেন একরকমের থেকে যাওয়াই। আমৃত্যু বুকের ভেতর বয়ে যাবে ডাউকি নদী ও খাসি যুবকের দাঁড়ের শব্দ।
"কেন বা যাবে না দূর বনে?
পাতার আড়ালে
কেন বা যাবে না ডালে ডালে?
ও দেশে পাবে
তোমার হৃদয়, যত ভাবে
পর্যটনময় ?
ঐ দেশে আছে কি সংশয়
প্রেমে ----"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴