সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
12-November,2023 - Sunday ✍️ By- অমিত কুমার দে 900

বুকবন্দী সেইসব মূহুর্তরা/অমিত কুমার দে

বুকবন্দী সেইসব মূহুর্তরা
অমিত কুমার দে
-----------------------------        

মূহুর্তরা বুকবন্দী হয়ে যায়। চিরকালের জন্য। এমন এমন মহার্ঘ্য মূহুর্ত জীবনে খুব কম আসে। আমি আনত সেই মানুষগুলোর কাছে যারা এমন সব হীরকদ্যুতিময় মূহুর্ত তৈরি করে দেবার কারিগর হয়ে থাকলেন।
আমি বলছি চিকরাশির দ্বিতীয় সাহিত্যের চড়ুইভাতির কথা। প্রথমটি হয়েছিল পাটকাপাড়ার (নিমতি) ইষ্টিকুটুম ফার্ম হাউসে, সুব্রত কুন্ডু-র নিপাট আত্মীয়তায় ও আপ্যায়নে। আবার হিমেল হাওয়া গায়ে লাগতেই মন উড়ু-উড়ু! প্রশান্ত নাথ চৌধুরী বললেন – আবার ইষ্টিকুটুমেই হোক। কিন্তু অনেকেই আবার নতুন কোনও জায়গায় যেতে আগ্রহী। যদিও চিকরাশির ভাবনা – ঘুরে বেড়ানোর বদলে প্রকৃতির কোলে একসঙ্গে আড়াই/তিনটে দিন থেকে সৃজন-আড্ডায় মেতে ওঠা, অন্তরের আরো কাছাকাছি আসা। 
আমি তো সদা ঘুরেই বেড়াচ্ছি! একটু ফাঁকফোকর পেলেই উধাও নিজের মতো! 
ঘুরতে ঘুরতেই পেয়ে গেলাম পাপরখেতি দারাগাঁও-এর হদিশ। লুংসেলে একটা হোম-স্টে-তে এক ট্যুরিস্ট বললেন – অভিনয় নেচারাল হোম-স্টে আপনার খুব মনপসন্দ হবে। দেরি না করে সেখানে পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম – এখানেই হবে দ্বিতীয় চড়ুইভাতির আয়োজন। চব্বিশ জন থাকবার বন্দোবস্ত। ‘যাব’ ;’যাব না’ করতে করতে ২৪ জন হয়েও গেল।
৪ নভেম্বর, ২০২৩ শনিবার সকাল সকাল ধূপগুড়ি থেকে দুটি ছোট গাড়িতে আমরা দশজন বেরিয়ে পড়লাম। একটার ড্রাইভার আমি, অন্যটা কৃষ্ণ চালাচ্ছে।  নাথুয়া থেকে খাজাঞ্চি দম্পতিকে তুলে ধূমপাড়া ছাড়িয়ে তোতাপাড়ার সবুজে পৌঁছতেই  অনুপম চিৎকার করে উঠল – “ওই দ্যাখো ময়ূর!” 
বাকিরাও শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালবাজার  থেকে জানিয়ে দিলেন পথে বেরিয়ে পড়েছেন তাঁরাও। বিভিন্ন দিক থেকে মোটামুটি এক সময়েই চলেছি!
অম্বিয়ক চা-বাগানের কাছে রণজিৎদার ছোট্ট চায়ের দোকান। আমার বড্ড প্রিয়। ওদিকে গেলেই ওখানে থামব! দোকানের পাশে বসে বসে চাঁদ দেখা আমার অন্যতম প্রিয় ভালোলাগা। থামলাম রণজিৎদার দোকানে। মো-মো খেতে খেতে ‘আহা আহা’ করতে লাগল মণি শুক্লা পপি মালবিকা। চায়ে চুমুক দিয়ে সবাই খুশি। ফোনে ফোনে জানতে পারছি বাকিরাও কাছাকাছিই আছেন। 
রণজিৎ কুমার মিত্র আমাদের আগে হোম স্টে-তে ঢুকে এক কাপ চা-ও পান করে ফেলেছেন। চোখমুখ দেখে বুঝলাম চড়ুইভাতির ঠিকানা তাঁর পছন্দ হয়েছে। প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যেই সবাই হাজির। শুরু হয়ে গেল অন্যরকম চড়ুইভাতি। সাহিত্যের চড়ুইভাতি! যা চিকরাশি সহজ উঠোনই একমাত্র ভেবেছে!
চারিদিকে ঘিরে রাখা পাহাড়। আর গাছ গাছ গাছ। টকটকে লাল হলুদ ফুলেদের মেলা। চেনা না-চেনা পাখিরা গান গেয়ে চলেছে। দূর থেকে একটা নদী বা ঝোরার আওয়াজও কানে আসছে। আমি ঘর বরাদ্দ করলাম ভয়ে ভয়ে! কিন্তু সব আশঙ্কা অমূলক!! কোনও প্রতিবাদ অপছন্দ নেই, যে ঘরে যাকে যাকে দিয়েছি, সবাই হাসিমুখে মেনে নিয়ে আমায় ভারমুক্ত করলেন। মানিয়ে নেওয়ার এই মানসিকতা আমাদের চড়ুইভাতির প্রধান শক্তি। স্বাভাবিকভাবেই ঘর বাছাইয়ে কোনও সময় নষ্ট হল না। শুরু হল পরিচয় পর্ব ও আড্ডা।  নিমেষেই সব্বাই সবার আত্মীয়। পরে সোনারপুরের আশিস অভিভূত হয়ে আমায় বলেছিল – ও কল্পনাও করেনি এত নিমেষে আপন হয়ে যাওয়া যায়। যেন সবাই পরস্পর কতকালের চেনা। অথচ অনেকেরই এখানেই প্রথম দেখা ও আলাপ। সব দ্বিধা পাহাড়ি মেঘের মতো এক নিমেষে উধাও!
প্রশান্তদা আমাদের যোগ্য অভিভাবক। তিনি এসেছেন দুই বান্ধবী চিত্রা পাল ও বেলা দে-কে সঙ্গে নিয়ে, তিনজনেই সত্তরোর্ধ্ব। কিন্তু কে বলবে তাঁরা প্রবীণ? তরুণকেও হার মানাচ্ছেন উৎসাহে আনন্দে। প্রশান্তদার সঙ্গী ভালো মানুষ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। সব কিছুতে মানিয়ে নেওয়ার এক অনবদ্য ক্ষমতা তাঁর স্বভাবজাত। প্রশান্তদা রসিকতা করে বললেন – “পার্থকে গান গাইতে না দিলে ও কিন্তু খুব খেপে যায় মনে মনে!” আমরা কোনও ঝুঁকি নিলাম না। পার্থদার গান দিয়েই শুরু হয়ে গেল চড়ুইভাতির মূল পর্ব। আমাদের খুব ভালো লেগেছে – এই মানুষটির কখনো খাতা কাগজ লাগে না গান গাইতে। কোনও ভনিতা নেই, গাইতে বললেই রাজি। তাঁর দরাজ গলা পাহাড়ের সঙ্গে মিলে গেল বেশ। আমরা সবাই আরো বেশি করে পার্থদাকে ভালোবেসে ফেললাম।
মোহর বলল – “এবারের চড়ুইভাতির থিম কি প্রেম?” কারণ গানে গানে প্রেম ভাসছে, কবিতাতেও প্রেম। মোহর - যার পোশাকি নাম অনুরিমা চন্দ, আমাদের স্বপ্নকন্ঠ মুক্তি চন্দ (আকাশবানীর কৃতী সঞ্চালিকা, অবসর নিয়েছেন) ও দমকলের উচ্চ আধিকারিক (অবসরপ্রাপ্ত) অতনু চন্দ-এর কন্যা, বীরসা মুন্ডা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা, সদ্য Contemporary American Literature  নিয়ে SUSI (Study of US Institute) Programme-এ University of Montana এবং নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসি ঘুরে এলেন ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে, দলিত সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যিনি আন্তর্জাতিক মানে কাজ করে চলেছেন, সেই মোহর উঠোনিয়াদের একজন ঘরের জন। গলা নাক সর্দিকাশিতে বেহাল হলেও মোহর গান ধরতেই আলো আর আলো। এই বিদূষী মেয়েটি সকলের নয়নমণি হয়ে উঠেছিল চড়ুইভাতি জুড়ে। দেশ-বিদেশ জুড়ে যার কাজের বিস্তৃত অঙ্গন, তাঁকে এক ফোঁটাও অহংকার ঔদ্ধত্ব ছুঁয়ে থাকে না কখনো। বড়দের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের ফাইফরমাশ খাটছে, ছোটদের সঙ্গে কী দারুণ মিশে যাচ্ছে, আবার বাবার পাশে বসে বাবাকে নিয়ে লেখা নিজের কবিতা শোনাতে গিয়ে সবার চোখে জলও এনে দিল। আমার “রাভাবস্তির কবিতা” বাংলায় এবং নিজের করা অসামান্য ইংরেজি অনুবাদ পড়ছিল ও, আর অদ্ভুত ভালোলাগা ভালোবাসায় ভরে যাচ্ছিল মন। ও জানাল – এবার আমার “রাজেশ্বরী” ইংরেজিতে অনুবাদ করে আরো বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে পৌঁছে দেবে। আমাদের মোহর, এমনই থেকো, একদম পালটে যাবে না। এই উদ্ধত সময়ে তুমি আমাদের বাতিঘর। 
রণজিৎদা প্রকৃত অভিভাবকের মতো একা একাই সবার আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন। প্রাজ্ঞ পন্ডিত মানুষটি এখানে যেন সহজ সরল এক শিশু। সবাইকে ভালোবাসলেন। তাঁকে আমরা বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক হিসেবে জানি, কিন্তু প্রাঙ্গণে বসে তিনি যখন তাঁর মা-কে নিয়ে তিনটি আন্তরিক কবিতা (সেফটিপিন, লন্ঠন ও পাকঘর) পড়লেন, আমাদের সকলের বুকে ‘মা মা’ কষ্ট। রণজিৎদাকে কাছ থেকে দেখছিলাম, আর মনে হচ্ছিল তাঁকে ঘিরে থাকে রবি ঠাকুরের গান। বিশুদ্ধ আলোয়। 
চিত্রাদি সবাইকে ভাসিয়ে দিয়ে শ্যামল মিত্র গাইছেন, রম্যরচনা পড়ছেন, বারবার জানিয়ে দিচ্ছেন “খুব ভালো আছি”, আর আমরা তাঁর কাছ থেকে বেঁচে থাকার আসল মানে শিখছি। বেলাদি কদিন আগেই কঠিন সার্জারি পেরিয়ে এসেছেন, দু-বার পড়ে গিয়ে আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েও মিষ্টি করে হাসতে হাসতে বললেন “আমি ঠিক আছি”, এবং হাসিমুখেই তাঁর কবিতা পড়লেন। এখানে এই উন্মুক্ত পরিবেশে কী নিবিড় করে বেলাদি চম্পাদি বললেন তাঁদের ভেতরে জমানো কান্নাগুলোর কথা। আমরা অনুজরা শুনছি, আর চোখ ভিজে যাচ্ছে। জীবন কতভাবে আমাদের কত কত পরীক্ষার সামনে ফেলে দেয়, দেয় তো! চম্পাদির মতো এত বড় শিল্পীর কী আন্তরিক অংশগ্রহণ! তাঁরা অজান্তেই আমাদের কত কিছু শিখিয়ে দিলেন।
সুদীপা দেব কোচবিহার থেকে এসেছে ওর যমজ পুত্র-কন্যাকে নিয়ে (শাশ্বত ও শুভমিতা), সঙ্গে ওর তুখোড় ড্রাইভার শান্তনু (অসামান্য ফোটোগ্রাফার)। শান্ত মেয়েটি সবার মন কাড়ল। কত নিবিড়ভাবে সবাইকে শুনল ও। এই শোনাটাও ইদানিং হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমে।  আর ওদের দুই ছানা তো সুকুমার রায় বলে, অভিনয় করে রীতমতো মাতিয়ে দিল! শান্তনু প্রথম দিন পাখির খোঁজে লাভায় ক্যামেরা হাতে উধাও হলেও দ্বিতীয় দিন শান্ত হাসিমুখ নিয়ে যোগ দিল উঠোনিয়াদের সঙ্গে। এত বড় মাপের ফোটোগ্রাফার পেয়ে মহিলাদের আনন্দ ধরে না, ফুলের বাগানে তাঁদের কত বিচিত্র  ভঙ্গিমা। পাখি বাদ দিয়ে বেচারা শান্তনু তখন পাহাড় ফুল আর মানুষ নিয়ে ছবি তুলেই যাচ্ছে।
কে যেন সত্যি কথাই বলল – মীনাক্ষী ঘোষ এই চড়ুইভাতির জীবনীশক্তি, লাইফলাইন। আমি জানি কত ঝড় ডিঙিয়ে মীনাক্ষী এসেছেন শুধুমাত্র চিকরাশি সহজ উঠোন আর অমিতের প্রতি ভালোবাসায়। এসেই সবাইকে নিয়ে আনন্দ-প্লাবনে মেতে উঠলেন। আবৃত্তি শিল্পে উনি একটা স্তম্ভ, অসামান্য বাচিক শিল্পী, সে সবাই জানেন, কিন্তু নাচে আড্ডায় কীসব কান্ড ঘটালেন তা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেনই না! তাঁর কন্ঠে জীবনানন্দ, সুনীল ছাড়াও আমার ‘নেশান’ স্থান পেল। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনলেন।
আশিস খাজাঞ্চি ডুয়ার্সপাগল, পায়ের তলায় সর্ষে! ওর ঘরনী আমার বোন, নাথুয়াহাটের মেয়ে মণিকুন্তলা (সেই কবে আমি ওকে পড়াতাম)। আশিসকে একবার বলতেই ও রাজি। এবং কী গভীরভাবে আশিস মণি সকলের সঙ্গে মিশে গেল। আশিস না থাকলে চড়ুইভাতির প্রতিটি মূহুর্তের এত এত ছবি ধরাই থাকত না। দারুণ ফোটো তোলে ও। সবাইকে আচ্ছন্ন করে পাহাড়ি ঢালে বসে আশিস বলে উঠল – “কেউ কথা রাখেনি...”। মণি মন থেকে গাইল রবীন্দ্রসঙ্গীত।
মুক্তিদি আমাদের অনেকেরই স্বপ্ন-মানবী। এমন একটা সময় ছিল, প্রতিদিন আমি আকাশবানীতে তাঁর কন্ঠ শোনবার জন্য অপেক্ষা করতাম। এবারও শোনালেন কবিতা, পাঠ করলেন চিত্রাদির গল্প। সবাই অভিভূত। তাঁর গৃহকর্তা অতনু চন্দ বড্ড ভালোমানুষ। ডাইনিং হলে বসে শোনালেন তাঁর আগুন নেভানোর ও মানুষ বাঁচানোর সত্যি গল্প। এক সুন্দরী তরুণীকে বাঁচানোর গল্পে সবাই হাসতে হাসতে একাকার! 
গল্পকার শাশ্বতী চন্দ নীরব, অথচ বাকময়। চুপচাপ নিসর্গ নিংড়ে নিচ্ছিলেন। হয়তো আগামি অনেক গল্পের পটভূমি অন্দরে বাঁধিয়ে রাখছিলেন! কম কথা বলেও কত কিছু বলা যায় – আপনি জানিয়ে গেলেন শাশ্বতী। আমাদের প্রাপ্তি শাশ্বতী চন্দ-র একটি গল্প ও একটি কবিতা। সবাই মুগ্ধ।
চড়ুইভাতির উপরি পাওনা – দ্বিতীয় দিন দুপুরবেলা হঠাত করেই এলেন আমাদের পরমাত্মীয় নীপা ঘোষ (কৃতী রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী) এবং চম্পাদির কন্যা সৌমিতা ভট্টাচার্য। নীপাদি সবাইকে মোহিত করলেন তাঁর অসাধারণ গানে। পাহাড় জুড়ে ভাসতে লাগল “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”, “মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে” এবং “দূরে কোথাও, দূরে দূরে...”। সৌমিতা এক বিস্ময়। এলেন এবং জয় করে নিলেন। কী অসামান্য কন্ঠ। যেমন আধুনিক, তেমনি নজরুলগীতি লোকগীতি ও অতুলপ্রসাদী – মাতিয়ে দিলেন বললেও কম বলা হবে। 

এবার চিকরাশির ঘরের মানুষদের কথা বলি। সম্পাদকীয় পরিবার। তাঁরা পাশে না থাকলে এমন আয়োজন কল্পনাতেও আনতে পারতাম না। মালবিকা এবার সঙ্গে নিয়েছে তাঁর জীবনসঙ্গী অনুপমকে। অনুপমের হয়তো সংশয় ছিল – মিলতে পারবে কিনা। মূহুর্তেই ও কিন্তু সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। কত কাজ করে ফেলল অনুপম। মালবিকা আমাকে ভালোবেসে আমার ‘রাজেশ্বরী’ সিরিজের সদ্যলেখা ‘হৈমন্তিক’ কবিতাটি পড়ল, কত যত্ন করে। আর ও তো অনেকেরই চোখের মণি হয়ে উঠেছিল পান-সুপারির সমৃদ্ধ বাক্সটির জন্য। নিজের মুখ লাল, অন্যের মুখ লাল করে দেওয়াতেও জুড়ি ছিল না এই মেয়েটির। সঙ্গে সাগরেদ তাঁর আদরের বৌদি  পপি। দুজনের নেওয়া মোটাসোটা পানের ডিব্বা দ্বিতীয় রাতেই প্রায় শূন্য!  
আর হনুমান দুটো না থাকলে চড়ুইভাতি ম্রিয়মাণ হয়ে যেত! কৃষ্ণ ও বিকাশ। আমার অজান্তে ও দুটো আমায় ‘বুড়ো’ বলে ডাকলেও আমি তো জানি বিপদে পড়লে এ দুটোই আমার ভরসা। সঙ্গে এবার আমার ছাত্র ও সহকর্মী সুব্রত বাড়ই। শান্তশিষ্ট ভালো ছেলে, ইতিহাসের গবেষক লেখক। শয্যা বরাদ্দ থাকলেও আমাদের ডর্মিটরিতে এক বিছানায় তিনটি থেকে যে সব খুনসুটি করে চলল তা বাকি আট জনের ঘুম কাড়লেও, বড্ড উপভোগ্য ছিল। কেউ কেউ এই চড়ুইভাতির ‘ত্রিরত্ন’ বলে এদের নামকরণ করলেন। চাষা কৃষ্ণ খুব ভালো লেখক হবার ক্ষমতা ধরে, কিন্তু লেখার বিষয়ে স্যারের হাজার বকা খেলেও বখাটে ও অলস। শুক্লা চড়ুইভাতিতে পাকা দায়িত্ব নিল – ভাই কৃষ্ণকে এবার লেখাবেই! বিকাশ যে এত ভালো ভাওয়াইয়া গাইতে জানে, অভিনয় করতে জানে, এত কাছে থেকেও তো এতদিন আমি জানতেই পারিনি। এবং দোষ অবলীলায় আমার ঘাড়েই চাপিয়ে ছাড়ল। “সব দোষ আপনার। আপনি সামনে থাকলে আমি কিছু করতে পারি না, ভয় লাগে – হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।“ 
শুক্লা চিকরাশি ও সহজ উঠোনের প্রাণশক্তি। কত কত দায়িত্ব নীরবে ও পালন করে সে শুধু আমি জানি। এ সময়ের অন্যতম শক্তিশালী লেখিকা ও। একটা ‘পইলা সাঞ্ঝির কথা’ লিখতে গেলে আলাদা দম লাগে, পর্যবেক্ষণ শক্তি লাগে। এখনও শুক্লা ওর যোগ্য সম্মান পায়নি। নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই ভালোবাসে মেয়েটি। জোরাজুরিতে ঝটপট দুটি অসামান্য কবিতা পড়ে অন্যদের পড়া শুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যথার্থ সহযোগী সম্পাদকের মতোই। 
পপি আকাশবানীর শিল্পী ছিল,  কৃতী বাচিক শিল্পীও। নিজের ঘরনী বলে বলছি না। (জনান্তিকে বলি – ওর গান এবং জীবনসংগ্রামই আমাকে জীবনের বড় একটা সিদ্ধান্ত নিমেষে নিতে একদিন উদ্দীপ্ত করেছিল)। এখন ঠাকুরঘর রান্নাঘর মেঝে ইত্যাদি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থেকে গান ভুলে থাকার জন্য নিত্য কলহ আমার সঙ্গে! তবু এখানে এসে স্বতস্ফূর্ত হঠাত গেয়ে উঠল – “আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনে/আমার চোখ বান্ধিবি মুখ বান্ধিবি পরান বান্ধিবি কেমনে ...”। যোগ্য সাথ দিল ওর কাছের ননদিনী মণিকুন্তলা। সবাই একাত্ম হয়ে গেল ওর গানের সঙ্গে।
ভোরবেলাগুলো ছিল বড্ড পবিত্র, সুন্দরতর। সানরাইস পয়েন্টে বসে যে গান ও কথাগুলো হল তা চিরকালীন আলোয় থেকে যাবেই গহনে। কোন গুম্ফা থেকে ভোররাত থেকে ভেসে আসত বৌদ্ধ মন্ত্র। মোহর কানে কানে বলছিল – শুনতে পাচ্ছ? বৌদ্ধ মন্ত্রের হাত ধরে যেন সকালটা আমাদের কাছে চলে আসত। তারপর গরম চা!   
এবার আমার কথা বলি! - একটা শ্রুতিনাটকের পাণ্ডুলিপি আর অনেকগুলো "রাজেশ্বরী" হাতে রেখেও পড়া হয়নি, সবারটা শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে রইলাম! আমার "রাজেশ্বরী" আমার মুঠোবন্দী রইলেন, যেমন থাকেন আর কি!! 
কতদিন পর (অকারণে হলেও) জোর বকা খেলাম! প্রশান্তদার বকুনি শুনে সম্পাদক কান ধরে ওঠবস করে ফেললেও পরে মনে হচ্ছিল কতকাল পর কেউ একজন আমায় এভাবে বকলেন! এটাও তো প্রাপ্তি! ভালোবাসলেই তো মানুষ এভাবে বকতেও পারেন। এই প্রশান্তদাই যাবার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শিশুটির মতো কেঁদে উঠলেন, আমিও তো কত চেষ্টা করেও চোখের জল আটকাতে গিয়ে পারলাম না কিছুতেই। 
আপনারা ভালো থাকবেন, প্রশান্তদা। আবার হবে তো চিকরাশির সাহিত্যের চড়ুইভাতি। পান্ডিত্যের কচকচানি, গরিমা, আমি-আমি সর্বস্বতা, মদো-নাগরিক ঘ্রাণ ... সব অসুখের বাইরে গিয়ে আমরা আবার এক হব, শুধুমাত্র ভালোবাসায়। 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri