পাপরখেতির চড়ুইভাতি/মণিকুন্তলা খাজাঞ্চি
পাপরখেতির চড়ুইভাতি
মণিকুন্তলা খাজাঞ্চি
এবারের দুর্গাপুজো আমার ঘরেই শুয়ে বসে কেটেছে। মাদূর্গা তার ছেলমেয়েদের নিয়ে চার দিনের জন্য তাঁর মায়ের কাছে আসেন। আর জ্বর-সর্দি-কাশি নিয়ে ২০ দিন ধরে আমার কাছে ছিলেন। অবশেষে জ্বর বিদায় নিতেই পুজো স্পেশাল ট্রেনে টিকিট পেয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে, ডুয়ার্সে।
হৈমন্তিক ডুয়ার্স - চারদিক ঝকঝকে, নীলাকাশের নীচে চা বাগানের সবুজ গালিচা, মাঠভরা কাঞ্চনধানের ওপর কাঞ্চনজঙ্ঘা কাঞ্চনরোদে ঝিকমিক করছে। ভোরবেলা বাড়ির শিউলি তলায় বসে শিশিরভেজা শিউলি কুড়ানোর সময় হিমেল হাওয়া এসে জানিয়ে দেয় - সব একই রকম আছে, শুধু এবারে আমার বাবা নেই। সারা বাড়ি জুড়ে কী যে শূন্যতা! এ শূন্যতা যে আর পূরণ হবার নয়।
এরই মধ্যে অমিতদাদা ও বৌদির ফোনে একঝলক খুশির বার্তা এসে সে শূন্যতার কিছুটা হলেও ভরিয়ে দিল। চিকরাশি সাহিত্যের চড়ুইভাতি আছে, দাঁরাগাও-এর পাপরখেতি যেতে হবে। আমি তো শুনে অবাক - এখন চড়ুইভাতি! গতবার জানি জানুয়ারিতে হয়েছিল। যাইহোক রাজি! রাজি! এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! এ তো সাধারণ চড়ুইভাতি নয়। কত গুণীজনের সান্নিধ্য পাব। বহু বছর ধরে আমি এই ডুয়ার্স পাহাড়ের চড়ুইভাতি হতে বঞ্চিত। তারমধ্যে সহজ উঠোনের কর্ণধার অমিত কুমার দে-র ব্যবস্থাপনায় এই চড়ুইভাতি সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও অভিনব হবে সেটা খুব ভালোভাবে জানি। অমিতদাদা শুধু আমার দাদা নয়, আমার শিক্ষাগুরুও বটে। সাহিত্যের প্রতি আমার যেটুকু ভালোবাসা, আগ্রহ - দাদার হাত ধরেই। এখনো শিখি, কত কী জানতে পারি।
৪ঠা নভেম্বর '২৩ সকালবেলা অমিতদা ও কৃষ্ণ স্যার দুজনে দুটো গাড়িতে ধূপগুড়ি থেকে সহজ উঠোন পরিবারের আরও আট জন সদস্যকে নিয়ে নাথুয়াহাট চলে এলেন। কৃষ্ণ স্যার-এর গাড়িতে আমি ও আমার কর্তা চেপে বসলাম। রওনা দিলাম ধুমপাড়া-বানারহাট রোড ধরে। আমাদের নেওয়ার জন্যই দাদাদের এই স্বল্প চেনা রোড দিয়ে যাওয়া। দূরে পাহাড়, বন, দু ধারে চা বাগানের সবুজের মধ্য দিয়ে সবার যেতে নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল। বানারহাট মেইন রোড এ উঠতেই অমিতদার গাড়ি আর দেখতে পেলাম না। দাদা এত ভালো গাড়ি চালায় যে চেনা পথ পেয়ে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। অম্বিয়ক চা বাগান পেরিয়ে রঞ্জিতদার চায়ের দোকানের সামনে দেখা পেলাম। মাঝপথে মোমো, চা-পান বিরতি। এখানে অমিতদার গাড়িতে ছিল - পপি বৌদি, শুক্লা ম্যাডাম, মালবিকা ম্যাডাম, অনুপমদা। বৌদি ছাড়া সবার সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ-এ আলাপ হল। মুখ পুস্তিকার পাতায় সহজ উঠোনে সবার লেখাতেই চিনি, জানি এই পর্যন্ত। সবাইকে মনে হল কতকালের চেনা। কত আপন করে নিল আমাদের। শীতের পাহাড়ি সকালে ধোঁয়া ওঠা গরম মোমো ও চা-এ রঞ্জিতদার দোকানের ভেতরে গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছিল। ওদিকে পাপরখেতির "অভিনয় হোম স্টে"তে সকাল এগারোটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। তাই আসর ভেঙে আবার রওনা দিলাম।
এবারের পথ বেশ চড়াই অনেকটা পাকদন্ডী পথ বেয়ে পাহাড়ের একদম মাথায়। আমাদের দু দিনের আস্তানা" অভিনয় হোম স্টে"। বাহবা দিতেই হয় অমিতদা ও বৌদিকে নীলাভ সবুজ পাহাড়ের কোলে এত সুন্দর রূপকথার রাজ্য নির্বাচন করার জন্য। লাল টিনের শেড দেয়া অপূর্ব দুটো কটেজ। চারদিকে লাল, হলুদ, নানা রংবেরংয়ের ফুল ফুটে রয়েছে, মন গেয়ে উঠল - 'হেমন্তে কোন বসন্তের ই বাণী...'। সূর্যের নরম আলোয় সারি সারি লালপাতা ফুল( poinsettia - আমি বলি লালপাতা ফুল) যেন আমাদেরকে বলছে - লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে...আয় আয় আয়রে ছুটে আয়রে...।
সত্যিই এবারে সহজ উঠোন পরিবারের সবাই কটেজের সামনের লনে জমায়েত হলাম। খুবই জনপ্রিয় "রাজেশ্বরী"র কবি অমিত কুমার দে-র কবিতা ও ছবি সহ অভিনব একটি ক্যালেন্ডার সবাইকে দিয়ে পরিচয় পর্ব সারা হল। একে একে চিনলাম, জানলাম সবাইকে। চিত্রাদিদি, বেলাদিদি, চম্পাদিদি ,মুক্তিদিদি, মীনাক্ষীদিদি, অতনু দাদা, প্রশান্ত দাদা, রণজিৎ দাদা, পার্থ দাদা - সবাই বয়সের কাছে হার মানেননি, মনে চিরসবুজ। জীবনের সমস্ত বাধাকে জয় করে আনন্দ খুঁজে তাঁদের ভালো থাকার এবং ভালো রাখার এই অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কুর্নিশ জানাই। তাঁদের কথায়, জ্ঞানে, ব্যবহারে নিজে সমৃদ্ধ হয়েছি। ভালো থাকুন ও সুস্থ থাকুন আপনারা। চিত্রাদি গান কবিতা সবেতেই চমৎকার। মীনাক্ষীদি, বেলাদি, চম্পাদি, রণজিৎদার কবিতা পাঠ এখনো কানে বাজে...."রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে"। প্রথম দিনে সূর্য যখন পশ্চিম পাহাড়ের আড়ালে, সেই গোধূলি আলোয় পার্থদার গান - দিনের শেষে ঘুমের দেশে...পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে সুরের মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছিল। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিদির মধুর কণ্ঠে আমরা আচ্ছন্ন ছিলাম। মোহর তো ছিল আমাদের সবার মধ্যমণি। তাকে শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। মিষ্টি হাসি মুখের শাশ্বতী ম্যাডাম-এর স্বরচিত কবিতা পাঠ মনে গেঁথে আছে। শান্ত-স্নিগ্ধ সুদীপা দেব ম্যাডাম-এর স্বরচিত কবিতা পাঠ হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দাদা শান্তনু দেব-এর হাতে ইয়াবড় DSLR ক্যামেরা দেখে আমরা তো ফুলের বনে, পাইন বনে শুধু ছবি তুলে দিতে ব্যস্ত করে দিচ্ছিলাম। তাদের মিষ্টি মিষ্টি ছেলে মেয়ে দুজন শাশ্বত ও শুভমিতা কবিতায়, অভিনয়ে আমাদের অবাক করে দিয়েছিল।
৫ই নভেম্বর'২৩ এ দুপুরে এলেন নীপাদি ও চম্পা দিদির কন্যা সৌমিতা। কী চমৎকার গানের গলা দুজনের! তারা পাহাড়ি ঝর্না হয়ে পাপরখেতিতে এসে আমাদের সুরের ঝর্না ধারায় ভিজিয়ে সেদিনই ফিরে গিয়েছিল। অনন্যা মীনাক্ষীদিও সেদিন বিকেলে ফিরে গিয়েছিল। সেই শোকেই বোধহয় সন্ধে নামার আগে পাপড়খেতির আকাশে বৃষ্টি নেমেছিল। বৃষ্টিকে ছোঁব বলে আমাদের কটেজের বারান্দায় গিয়ে দেখি "পয়লা সাঞ্ঝির" লেখিকা শুক্লা ম্যাডাম বৃষ্টিভেজা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। "পাহাড় কিনব বলে" একটা কবিতাই লিখে ফেলল। আর পার্থদা তো কবিতায় ধারা বিবরণী হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ-এ দিয়ে যাচ্ছেন। চোখের সামনে সহজ উঠোনের এত এত মণিমানিক্য দেখে পপি বৌদির কথা মনে হল - " এই উঠোনে আমি আর মণি বেকার (মানে চাকুরে নই), দুজনে তাই এক বিছানায়"। যদিও বৌদি বেকার নয়, আমরা জানি বৌদি উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় বেতার শিল্পী। দাদা বৌদির শ্রুতিনাটক আমার বড় প্রিয়, শোনা হল না এবারে। দশ জনের ডরমিটরিতে ভীষণ মজায় কেটেছিল । শুক্লা ম্যাডাম, মালবিকা ম্যাডাম এক বিছানায়, অন্যদিকে বৌদি ও আমি এক বিছানায়। বৌদি সবসময় আমার পাশটিতে থেকেছে ও পরম যত্নে রেখেছে। ননদিনী বলে কথা! মালবিকার নিপুণহাতের বানানো পান ভুলতে পারব না, খুব মিস করছি। আশিস স্যার আকাশ, বাতাস, পাহাড়, সবাইকে "কেউ কথা রাখেনি" শুনিয়ে দিয়ে অমিতদার কথা রেখেছিলেন, সুন্দর নিসর্গ পেয়ে প্রতিটি মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করেছিলেন। ইতিহাসের গবেষক সুব্রত স্যার, বিকাশ স্যার (অসাধারণ ভাওয়াইয়া গান শুনলাম রেকর্ডিং-এ), কৃষ্ণ স্যার (ভালো লেখেন, কবিতা পড়েন, দুরন্ত ফসল ফলান) সব্বাই এই চড়ুইভাতি জমিয়ে রেখেছিলেন, ওনাদের কর্ম দক্ষতায় ও গুণে। আমাদের লাভার পথে পাইন, ফার্ন-এর রাস্তায় দৌড় করিয়ে রিল তুলে দিয়েছিলেন সম্ভবত সুব্রত স্যার।
ঘরে ফেরার দিন একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা থেকে জোর বেঁচে ফিরেছে আমাদের দল, সেকথা বলি। সেদিন বৌদি বলল - "মণিকে আমাদের গাড়িতে নেব।" ছেলেরা একটা গাড়ি, মেয়েদের একটা গাড়ি। ছেলেদের গাড়ির ড্রাইভার কৃষ্ণ স্যার, মেয়েদের গাড়ির ড্রাইভার অমিতদা। আমি তো শুনে বললাম - "না,না,অমিতদা যা উড়িয়ে গাড়ি চালায় আমি যাব না।" কিন্তু কৃষ্ণ স্যার এর গাড়িতে কেউ আমায় জায়গা দিল না, অগত্যা অমিতদার গাড়িতে। অমিতদা কিন্তু এই লাভার চড়াই পথে স্পীড কমিয়ে সুন্দর গাড়ি চালিয়েছে, সেখানে কৃষ্ণ স্যার এই চড়াই পাহাড়ি পথে নামার সময় তাদের "স্যার"-এর চেয়ে বেশি স্পীড-এ গাড়ি চালিয়ে ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তখন সারাটা পথ সমতলে নামা পর্যন্ত দেবদূতের মতো আমাদের পাশে থেকেছেন পরম বন্ধু শান্তনু দেব স্যার ও সুদীপা ম্যাডাম। মনে থাকবে চিরদিন! শেষ ভালো যার, সব ভালো। সবাই সেদিন ঠিকঠাক যে যার ঘরে পৌঁছেছিলেন। আমাদের অমিতদা নাথুয়াতে নামিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন।
ফুরফুরে আনন্দ মাখা এই দুটো দিন ছিল গল্প, গান, কবিতা, নাচ, জমজমাট আড্ডা আর প্রাণখোলা হাসিতে ভরপুর। শরীর, মনে কোনো অসুস্থতা ছিল না। নীল পাহাড়ের কোলে এত রঙীন নিসর্গ, তার মাঝে এই যে সাহিত্যিক, কবি ও লেখকদের এমন মূল্যবান মিলনমেলা - এ তো ধরে বেঁধে নিয়ে আসার সাধ্য নেই। শুধু তার রেশটুকু ও মধুর স্মৃতি মনের মণিকোঠায় ভরে নিয়ে এলাম। ভরা থাক্ স্মৃতি সুধায়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴