সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

দারাগাঁও-এর উজ্জ্বল স্মৃতি/পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

দারাগাঁও-এর উজ্জ্বল স্মৃতি 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

পাহাড়ের কোলে সবুজের ঘেরাটোপে ব্যাস্ততম জীবনের কিছুটা  সময়  রেখে এলাম দারাগাঁওতে,  নিয়ে এলাম হাজারো সুন্দর মুহূর্ত। সাহিত্যের তীর্থভূমি সহজ উঠোনের কলমযোদ্ধাদেরও তো একটু খোলা হাওয়া চাই, একটু  মুক্তি চাই, এই কথা ভেবেই আমাদের সবার শ্রদ্ধেয়া, সুমধুরভাষিনী মুক্তিদি (বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী মুক্তি চন্দ) প্রস্তাব  দিয়েছিলেন সাহিত্যের চড়ুইভাতির । সেই প্রস্তাবকে অক্ষরে অক্ষরে  বাস্তবায়িত করেছিলেন অমিতদা।  সেটা ছিল কালচিনির নিমতিতে। ইষ্টিকুটুম ফার্ম হাউসে  মুক্তিদি 'র অপূর্ব কন্ঠের আবৃত্তি শুনেছিলাম। শুনেছিলাম তাঁর কন্ঠে গল্পপাঠ।  সেই মধুর স্মৃতি ম্লান হওয়ার আগেই  বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবারও খোলা আকাশের নীচে পাহাড়ের কোলে চড়ুইভাতির ডাক এল সহজ উঠোন পরিবার থেকে। এবার সাজো সাজো রব উঠেছে গরুবাথান হয়ে লাভার রাস্তায় পাঁপড়খেতির,  দারাগাঁওতে।  ঘড়ির কাঁটায় বারোটা বাজার আগেই একে একে পৌঁছে গেলেন সব আপনজন। একটা শীতের হিমেল হাওয়ায় মেতে  উঠেছে এই শান্ত পাহাড়ি বনভূমি। দূরে পাহাড়ের নীচে পাহাড়ি বনবস্তি। একে একে দেখা গেল  অক্ষরকর্মী, সঙ্গীতশিল্পী ও বাচিক শিল্পীদের।

পাহাড়ের গায়ে কোথাও রোদ কোথাও কুয়াশা। একগাল হাসি নিয়ে হাত নেড়ে গাড়ি থেকে নামলেন অতনুদা। একজন আদ্যোপান্ত ভালো মানুষ  তিনি। একটা সহজ আনন্দ ভাগ করে নিয়ে কিভাবে কৈশোর,  যৌবনের আনন্দে সামিল হওয়া যায় সেটা শিখে নিতে হয় অতনুদার কাছ থেকে। একটা অজানা অচেনা স্থান ও মানুষের কাছ থেকে কিভাবে তার রূপ ও ঐশ্বর্য  আস্বাদন করতে হয় সেটা তাঁর কাছে শিখেছি। কাউকে ভালবেসে কিভাবে  আপন করতে হয় তার পাঠ নেবার জন্য তিনি একজন  আদর্শ মানুষ।  ঝকঝকে এই মানুষটির হৃদয় বুঝতে গেলে তার মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরই যথেষ্ঠ। সদা সর্বদা সকলের প্রশংসা করে চলেছেন।  কারো মন্দ দিকটি তাঁর কখনোই  নজরে আসে না। আর আসে না বলেই হয়তো তিনি এত সুন্দর। চন্দ পরিবারের কল্যাণেই
মোহরের (ড:অনুরিমা চন্দ)  মতো একটি মহীয়সী গুণীকে আমরা আমাদের চিকরাশি সাহিত্য  পরিবারে  পেয়েছি। যে তাঁর  সাহিত্য এবং সাধনায় গোটা পৃথিবীর কত বড়ো বড়ো  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার সাহিত্য কর্মের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। একটা মুক্ত দানার মতো মেয়ে গোটা পৃথিবীতে  বাড়ির উঠোনের মতো বিচরণ করে চলেছে। সব থেকে বড় কথা  বিদেশেও ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব  করে  সবার মন জয় করে আসছে। তার অসামান্য   সারল্য এবং নিরহঙ্কারী স্বভাব বলেই  তাঁর প্রাপ্তি এবং উচ্চতা বাইরে থেকে  দেখে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। শুনলাম তার কন্ঠে,  "আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা... "  এবং অমিতদা'র কালজয়ী কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। 

ইতিমধ্যে সবাই গোল হয়ে বসে রোদচেয়ারে আলাপ জমিয়ে ফেলেছি।  প্রাবন্ধিক দাদা  প্রশান্ত নাথ চৌধুরীর স্বভাবসিদ্ধ হাসিমজা চালু আছে।  তিনি  "তিস্তা নদী"কে নিয়ে সম্প্রতি  খুব বড়ো কাজ করে চলেছেন। সদা প্রাণচঞ্চল এই মানুষটি ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান যে একেবারে ফিকে একথা বলাই বাহুল্য। 

চা এবং টা-এর সাথে আমরা সবাই পেলাম উপহার। কবি অমিত কুমার দে'র কবিতা এবং ছবি সম্বলিত এক অসাধারণ টেবিল ক্যালেন্ডার। এই মহামূল্যবান  স্মারক ঝুলিতে  ভরে নিলাম।  সহজ উঠোনের কর্ণধার এবং  অতি  সহজ এই  মানুষটির কাছে আমরা  সব সময় শিখি। গতবার তাঁর ক্যাপ্টেনশিপ দেখেছিলাম।  একটা নিঁখুত অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছিলেন।  শুনেছিলাম তাঁর শ্রুতি  নাটক, গান আর রাজেশ্বরী।  অমিতদা'কে কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি,  তাঁর সংযমী  জীবনসংগ্রাম থেকে যে  জীবনবোধ  তিনি অর্জন করেছেন তার  সবটাই ঢেলে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে, কাব্যে আর রচনায়।  তাঁর কবিতায় যাপন কখনোই এত সুন্দর হত না যদি  পপি বৌদি তাঁর সহধর্মিণী না হতেন। বিধাতার অমোঘ বিধিলিপি এই দুটি সহজ, নির্মল হৃদয়কে একসূত্রে বেঁধে  দিয়েছেন। এবারও সূর্যোদয়ের আলোতে তিনি, রঞ্জিতদা, শুক্লাদি  গাইলেন,  "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।" এবং শুনলাম তার সাংবাদিকতার জীবন, শিক্ষকতার জীবন এবং জীবনসংগ্রাম। 

সাতটা না বাজলে যাদের সকাল হয় না তাদের ভোর সাড়ে পাঁচটায় ওয়াচ টাওয়ারে হাজির করানোর মতো কঠিন কাজটি করেছিলেন সবার প্রিয় শুক্লাদি।  সত্যবাদী স্পষ্টবাদি কথাশিল্পী শুক্লা রায়  সহজ উঠোনের একটি স্তম্ভ। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি "পইলা সাঞ্জির কথা" যেন  সমাজের একটা দর্পণ । শুক্লাদি'র কবিতা শুনলাম।  শুনলাম শিক্ষক  কৃষ্ণ দাসের রোমাঞ্চকর জীবনস্মৃতি।  যিনি  নিজে সোনার ফসল ফলান এবং গর্বের সাথে নিজেকে 'চাষা'র পরিচয় দেন।  মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে কম কথা বললেও, যখন বলেন তখন তা শুনতেই হবে। সঙ্গে তাঁর বন্ধু স্বভাবরসিক বিকাশ চন্দ্র রায়। বিকাশ সবাইকে ভালোবাসায় বাঁধলেন এবং কাউকে কাউকে শোনালেন অপূর্ব ভাওয়াইয়া গান।

মালবিকা চাকির নিরন্তর সহযোগিতায় সহজ উঠোন এগিয়ে চলেছে, সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাঁর কবিতা শুনলাম। মিশে গেলেন স্বভাবসিদ্ধ স্বজনের ভঙ্গিতে। 

বিশিষ্ট বাচিক মীনাক্ষী ঘোষ চিকরাশি সাহিত্য পরিবারের সম্পদ। এই অসাধারণ গুণী শিল্পীকে  এককথায় বলতে গেলে বলতে হয় একটা "খোলা বইয়ের পৃষ্ঠা" ( খুলি কিতাব কি পন্না)। তাঁর হাত ধরে কখনো নেচেছিলাম। তার কল্যাণে এবং সুদীপার উৎসাহে,  হয়তো কয়েক দশক পরে,  কবিগুরুর একশ দশ বছরের পুরনো গানের লাইন মনে মনে আওড়াতে পারব  "সেদিন দুজনে দুলে ছিনু বনে....  "  দারাগাঁওতে না গেলে হয়তো বা  চৌষট্টি কলার শ্রেষ্ঠ (নৃত্য কলা) কলাটিতে জীবনে কখনোই  অংশ নিতে পারতাম না। এমনই থাকুন আপনি। 

 সুদীপা,  শুভমিতা, শাশ্বত না থাকলে এই চড়ুইভাতি অসম্পূর্ণ থাকত এই রকম  উপলব্ধি আশা করি সকলের। দুই যমজ ভাই-বোনদের মধ্যে কি মিল, কতটা বন্ধনে আবদ্ধ তা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি। তাদের যুগ্ম পরিবেশনায় জীবন্ত হয়ে উঠলেন কবি সুকুমার রায়। 

রণজিৎ কুমার মিত্র বাংলা সাহিত্যে এক সুপরিচিত নাম। তার লেখা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অজানা তথ্য আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। তিনি বলেন কম, কিন্তু যতটুকু বলেন তা মনে গেঁথে যায়। সেই দেখতে রাশভারি কোমল হৃদয়ের মানুষটির সাথে দুই রাত কাটিয়ে তাঁর সাহিত্যে যাপন নিয়ে অনেক কিছু ঝুলিতে  ভরে নিলাম।

বেলাদি, চিত্রাদি, আমরা একসাথেই এক গাড়িতেই গিয়েছিলাম। তাঁদের দুজনের অনেক অভিজ্ঞতা অনেক গল্প শুনলাম, দু'দিন ধরে। কবিতা পাঠ করলেন বেলাদি। গল্প এবং গান শোনালেন চিত্রা দি।

বিশিষ্ট  বাচিক শিল্পী চম্পা ভট্টাচার্য আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।  বলা যায় ফেসবুকের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন।  তাঁর সাথে  মুখোমুখি  দর্শনের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম।  এমন মাতৃসুলভ বন্ধুত্ব যে কতখানি  দামী তা শুধুই অনুভব করবার।  সে কথা এত স্বল্প পরিসরে বোঝাতে পারব না। 

গল্পকার শাশ্বতী চন্দ একবার জলপাইগুড়িতে এসেছিলেন,  গল্প পাঠের আসরে। দূর পাহাড়ের গায়ে যেখানে আগুন জ্বলছে, সে দিকে তাকিয়ে বললেন,  "আমি ছবি তুলি না।" কিন্তু পর দিন সকালে হলুদ ফুলের বনে আমার ছবি তুলে দিলেন।  তাঁর নিটোল গল্পে সব চরিত্ররা ছবি  হয়ে ধরা দেয়।  তিনি বোধ করি গুনে গুনে শব্দ ব্যবহার করেন। এত কম কথা বলা মানুষ আমার চেনা জানার মধ্যে বিরল, কিন্তু সব কিছুতেই তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়।  তাঁর নিবিড়  সান্নিধ্য অনেক দিন মনে থাকবে।

ক্রীড়া প্রেমী অনুপম দত্ত বিশ্বকাপে মেতে থাকলেন ও আমাদের খেলার আপডেট দিয়ে গেলেন। এই মানুষটি সহজ উঠোন-এর বন্ধু এবং কবি  মালবিকা দত্ত চাকীর জীবনসঙ্গী।  তারা দুজনেই একে অপরের পরিপূরক। মাতিয়ে রাখলেন কথায় কবিতায়, গল্পে  ও গানে।

দিন ফুরিয়ে আসে সন্ধ্যা নামে আরও নিবিড়ভাবে পরিচিত হই একজন নতুন বন্ধুর সাথে।  হ্যাঁ  গবেষক শিক্ষক  সুব্রত  বাড়ই এবার চড়ুইভাতির বাড়তি পাওনা, তাকে চিনলাম,  অনেক অজানা বিষয় জানলাম তাঁর কাছ থেকে।  শুনলাম তার দরাজ কন্ঠে উত্তরবঙ্গের প্রসিদ্ধ ভাওয়াইয়া  গানগুলো। 

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত প্রকৃতিকে ক্যামেরা বন্দী করে চলছেন,  দুটি উজ্বল চোখ - সুদুর সোনারপুর থেকে আগত একজন নীরব বন্ধুর সাথে আলাপ হল এবারের চড়ুইভাতিতে। তিনি শিক্ষক আশিস খাজাঞ্চি।  ছবি তোলা তাঁর নেশা। এত কম কথা বলে সবার মনে   এত বড় প্রভাব ফেলে  বিদায়লগ্নে মনকে কাঁদিয়ে দিলেন।  তাঁর সাথে আবার দেখা করবার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে পুষে রাখলাম।  পুষে রাখলাম তার হোম মিনিষ্টার  মণিকুন্তলাদির রবীন্দ্রসংগীত শোনবার ইচ্ছেটা। মণিকুন্তলাদি গাইলেন, "কবে আমি বাহির হলেম, তোমারই গান গেয়ে....." সবাই উদাস হয়ে গেলেন। গানের সুর দূর পাহাড়ের বৌদ্ধ মনেষ্ট্রির প্রার্থনা সঙ্গীতের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

এবারের চড়ুইভাতির গেষ্ট এপিয়ারেন্স-এর খামতি ছিল না আমরা পেয়েছিলাম বিশিষ্ট  রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নীপা ঘোষকে। গাইলেন তিনটি কালজয়ী রবীন্দ্রসংগীত।  তাঁর কন্ঠে, "দূরে কোথাও, দূরে... " আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল অজানা দূরদেশে।

শেষ দিন   অসাধারণ সারল্যের অধিকারী   বৈচিত্রপূর্ণ গানের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছিল বাচিক শিল্পী চম্পা ভট্টাচার্য-এর কন্যা  সৌমিতা।  তাদের গানে নেচে উঠল রৌদ্রছায়ায় ঘেরা ফুলে ফুলে ঢাকা সবুজ বনবীথির পাহাড়ি দারাগাঁও। এই সুখস্মৃতি কখনোই ভোলবার নয়।  আমরা যখন অভিনয় হোমস্টে থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম, তখন মুক্তিদি র কন্ঠ কানে বাজছে - "আবার আসিব ফিরে.... "।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri