জঙ্গলে মঙ্গল নাই/সুদীপা দেব
জঙ্গলে মঙ্গল নাই
সুদীপা দেব
--------------------------
সংসারী
মনের ভেতর আর এক বাউন্ডুলে মনের তাড়নায় মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তে হয়।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের অভাব নেই। পাহাড়-জঙ্গল সমুদ্র মরুভূমি সবই
নিজস্ব বৈচিত্রের বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। বেরিয়ে পড়লেই হল।
শরীরে-মনে শুধু অনুভব করার অপেক্ষা। পরিবেশ এবং সমাজপ্রেমী অরূপ গুহ বলেন
"ঘরের ভেতর কিছুই নাই। যা আছে সব ঘরের বাইরে।" সত্যিই তো!
বসন্ত
মাস শেষ হতে চলল। পয়লা বৈশাখের দু'দিন আগে নিউ কোচবিহার রেলস্টেশন থেকে
ব্রহ্মপুত্র মেল ধরলাম রাত নটায়। আসামের ব'হাগ বিহু দেখব বলে এই সময়টা
বেছে নিয়েছিলাম। পরদিন ভোর পাঁচটায় পৌছে গেলাম গুয়াহাটি। রেলওয়ে
রিটায়ারিং রুমে ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে গুয়াহাটি বাস টার্মিনাস থেকে
বাস ধরলাম। বাস চলেছে গুয়াহাটি-জোরহাট হাইওয়ে দিয়ে। জানালা দিয়ে দেখতে
পাচ্ছি বাঁশের চাটাই ও মাটি দিয়ে তৈরি গ্রামীণ আসামের বিশেষ ধরণের
বাড়িগুলো। ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই হয়তো এভাবে বানানো হয়।
তবে ইদানিং পাকা ছাদের বাড়িও প্রচুর দেখা যায়।
জখলাবান্ধা
পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। বড় বড় কয়েকটি ধাবা রয়েছে। বাঙালি খাবার
প্রায় সবই পাওয়া যায়। লাঞ্চ সেরে আবার রওনা হলাম। জখলাবান্ধা থেকে আধ
ঘন্টার রাস্তা পার হতেই রাস্তার দু'ধারে দূরে দূরে হাতি গন্ডার চড়ে
বেড়াচ্ছে। এ যেন এদিকের গরু ছাগল চড়ে বেড়ানোর মতো। নিজের চোখকে বিশ্বাস
করতে পারছি না! বেশ রোমাঞ্চিত লাগছে। বুঝতে পারছি কাজিরাঙ্গা বেল্টএ ঢুকে
পড়েছি। বিকালে পৌঁছলাম কোহরা। সেখান থেকে পরদিন সকালে যাব কাজিরাঙ্গা
ন্যাশনাল পার্ক। কাজিরাঙ্গার জঙ্গলে জিপ সাফারি এবং হাতি সাফারি দুরকমই
এভেইল যায়। আমরা জিপ সাফারি বেছে নিলাম। কারণ আমাদের সাথে চার-পাঁচ বছর
বয়সী তিনজন খুদে রয়েছে। তাদের প্রোটেকশন-এর ব্যাপারটা ভেবে এই ব্যবস্থা।
শুনেছি মওকা মতো বাঘের আক্রমণও হয়।
ওয়েদার খুব
ভালো। ভোর থেকেই ঝনঝনে রোদ। সকাল সকাল রিসোর্টের সামনে থেকে আমরা তেরো জন
দুটো জিপে ভাগ হয়ে উঠে পড়লাম। আমাদের আসামিস ড্রাইভার জঙ্গলে ঢোকার
পারমিশন করে আনে। সে অবশ্য দু'ঘন্টা সময়ের ঝক্কি। যাক তবু পারমিট পেয়ে
মহানন্দে গাড়িতে চললাম। শুনেছি বন্দুকধারী এসকর্ট থাকার কথা প্রত্যেক
গাড়িতে। সেসব অবশ্য কাগজে-কলমে।
পাকা
রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে মাটির পথ ধরলাম। খুব উত্তেজনা মনে মনে। হুড খোলা জিপে
দাঁড়িয়ে নিজেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর রিপোর্টার মনে হতে লাগল। জঙ্গলে ঢোকার
মুখে বনবস্তি এবং অনেকটা জায়গা জুড়ে জলাভূমি। বর্ষায় এসব অঞ্চল সম্পূর্ণ
জলের নীচে চলে যায়। বন্য প্রাণীরা তখন মানুষের বাড়িতে এমনকি দলে দলে
হাইওয়েতেও আশ্রয় নেয়। বন্যার জলে ভেসে মারা পড়ে প্রচুর জঙ্গুলে। চোখের
নাগালে দেখতে পাচ্ছি অগণিত বাইসন গন্ডার হাতি ময়ূর অচেনা কিছু পাখি। আমরা
নিঃশব্দ। আরো গভীরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। অতি দ্রুত ঝলমলে রোদ পড়ে যাচ্ছে।
কালো মেঘে ঢাকা পড়ছে আকাশ। শুরু হয়ে গেল প্রবল ঝড়ো হাওয়া। তারপরই
প্রচন্ড বিদ্যুতের ঝলকানি। ততক্ষণে ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে গাড়ি। আমরা মাটির
রাস্তায় আর মাত্র দশ হাত দূরে বাচ্চাটা শুয়ে আছে। মা-বাবা (হয়তো)
হাতিরা ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় বাচ্চাটা অসুস্থ। আকাশের অবস্থা আরো
খারাপ হতে শুরু হয়। বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি। গাড়িতে হুড তুলে দেওয়া হল।
এদিকে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার বিহুর প্রসাদ খেয়ে প্রায় বেসামাল অবস্থা।
বন্য জন্তু ভরা জঙ্গলে তিনি আমাদের ভরসা দেবার অবস্থায় নেই। ইতিমধ্যে একটা
গাছের সাথে ধাক্কাও লেগেছে। গাড়ির সামনে বাঁদিকের চাকার রিং ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। এবার ভীষণ ভাবে প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পাচ্ছি। মাটির রাস্তা ভিজে
সপসপে।যেকোন মুহূর্তে গাছের ডাল ভেঙে পড়তে পারে আমাদের ওপর। এই অবস্থায়
জঙ্গলের আরো গভীরে ঢুকতে সাহস পেলাম না। ড্রাইভারকে গাড়ি ফেরাতে বলা হল।
ততক্ষণে তার নেশা আরো চড়ে বসেছে। গাড়ির স্টিয়ারিং থেকে হাত পিছলে
যাচ্ছে। নিজের সিটে এলিয়ে পড়েছে। একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলেই যেন ভালো
লাগতো। তাকে অনবরত বলে বলে জাগিয়ে রেখে একটু একটু করে এগোচ্ছি। হঠাৎ দেখি
রাস্তা আটকে বাচ্চাসহ অতিকায় গন্ডার। জঙ্গলের একফালি ভেজা মাটির রাস্তার
একপাশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে পানাভরা জলাভূমি আর একপাশে সারি সারি বড় গাছ।
গাড়ি ফেরানোর রাস্তা নেই। খুব ধীরে ধীরে সামান্য একটুখানি পেছাতেই অন্য
আরো দু-চারটি গাড়ির লাইন পড়ে গেল। পিছিয়ে যাবার পথও বন্ধ। অগত্যা প্রাণ
হাতে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। গন্ডার এবার খড়্গ উঁচিয়ে আমাদের
গাড়ির দিকে দৌড়ের ভঙ্গিতে খানিকটা এগিয়ে এলো। আমরা নিশ্চিত হলাম এই ঘন
জঙ্গলে বাচ্চাকাচ্চাসহ গন্ডারের আঘাতেই আমাদের মৃত্যু। মৃত্যুভয়ে শরীর
ক্রমশ ঠান্ডা হতে লাগল। কাঁদো কাঁদো স্বরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে দেব দেবতার
কান ঝালাপালা করছি, হঠাৎ কি মনে হল ভয়টুকু দেখিয়ে বাচ্চা নিয়ে চলে গেলেন
জঙ্গলের আড়ালে। তিনি অতটা নিরীহ না হলে হয়তো আজ বসে এই দু'চারটি লাইন
লেখা হত না। তখন বোঝার অবস্থায় না থাকলেও পরে বুঝেছি - পৃথিবীর সকল মায়ের
মতো সেও বাচ্চার সুরক্ষার কথা ভেবে ওই ভাবে তেড়ে এসেছিল অচেনাবাসীর দিকে।
আমরাও রিসোর্টে ফিরে এলাম ভয়ানক অভিজ্ঞতার সঙ্গী হয়ে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴