সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
01-February,2023 - Wednesday ✍️ By- সুকান্ত নাহা 908

চিসাং : যেখানে অপেক্ষায় থাকে রক্তিম ভালোবাসা

চিসাং : যেখানে অপেক্ষায় থাকে রক্তিম ভালোবাসা 
সুকান্ত নাহা
------------------------------------------------------------                                                                                           
আমার ছোট্ট বাসার একমুঠো বারান্দায় উত্তুরে হিমেল হাওয়া এসে  ফিসফিসিয়ে ঘর ছাড়ার মন্ত্র শুনিয়ে যায়। নীল পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে।বর্ষা বিদেয় হলে হেমন্তের ঝলমলে কমলা রোদ বাতাসের লেফাফায় মুড়ে পাঠায় নিমন্ত্রণ," এসো, চলে এসো। আর দেরি কেন ? তোমার জন্যই তো রূপের তোড়া সাজিয়ে বসে আছি কতকাল..."বুকের ভেতর তখন ডানা ছটফটায় সবুজ টিয়ে। পায়ের তলায় সুড়সুড়ি জাগে। আমার  উঠোন থেকে হাত বাড়ালেই পাহাড় জঙ্গলের নিবিড় ঘর সংসার। সেই সবুজ গেরস্থালির অন্ধিসন্ধি থেকে কত না ডাক এসেছে। কত অপরূপ রূপসীরা কত না শরীরি বিভঙ্গে, মোহময়ী  লাস্যে চোখের ইশারায়  দিয়েছে ডাক তার  ইয়ত্তা  নেই।  তাদের কারও নাম কুমাই, কারো নাম লোলেগাঁও কারও বা ইচ্ছেগাঁও, ঝান্ডি,  লামাহাটা, চারখোল,  রিশপ,  সিটং,  চিলাপাতা,  জয়ন্তী,  লাভা,  তোদে,  তাংতা,  গোদক,  চিসাং  এমন  হাজারো  নাম । কারও  ডাকে সাড়া দিতে পেরেছি কারও বা পারিনি।  তারা মুখভার করেছে কালো মেঘের মতো। পারিনি, কেননা আমার পায়ের নিচে তো সর্ষে নয়, পায়ে  শেকল । 'জড়ায়ে রয়েছে বাধা', ছাড়ায়ে যেতে চাইলেও যে যাওয়া হয়ে ওঠে না প্রায়শই। তবে "পায়ের তলায় সর্ষে" তকমাধারী  আমার  দুই  গুরুপ্রতীম  দাদা  শ্রী গৌরীশঙ্কর  ভট্টাচার্য  ও শ্রী শিশির রায়নাথ  এঁদের  মুখে  জায়গাটার  নাম বহুবার  শোনা।  জায়গার  চেয়েও  বেশি  প্রশংসা  শুনেছি  একটি   ছেলের, যার নাম অ্যাড্রোনিকাস রাই । চিসাং  ওয়াইল্ডউডস  রিট্রিটের  কনিষ্ঠ  কর্ণধার,  রূপকার,  স্বপ্নদর্শী  এক  যুবক।  তার  ফোন  নাম্বার  জুগিয়েছিলেন গৌরীবাবু বছর দুয়েক আগে। সঙ্গে গালভরা প্রশংসা," ওখানে অ্যাড্রোনিকাসকে পাবে। খুব ভাল ছেলে। চলে যাও। জায়গাটাও চমৎকার। " তিনিও গেছিলেন শিশিরদার কাছে শুনেই। ২০১৮ সনে হোম-স্টে-টি স্থাপিত হওয়ার পর  সম্ভবত শিশিরদাই  জায়গাটি  আবিষ্কার  করেন।  তারপর যদিও  পরিচিত  দু'জনকে  অন্তত  পাঠিয়েছি  সেই  চিসাং  সুন্দরীর কাছে। ফিরে এসে  তারাও বেজায় খুশি। তবু আমার আর যাওয়া হয়নি চিসাং-এর  দুয়ারে  এতকাল ।   
 যাই হোক, পরের মুখে ঝাল খেয়ে কার আর কবে ষোলো আনা স্বাদ মিটেছে। কদিন ধরেই ভাবি কোথা যাই, কোথা যাই। গৌরীদাকে ফোন করে বেশ  কয়েকটি জায়গার নাড়িনক্ষত্র জেনে নিই। মনোজ ভাইও হদিশ দেয় দু চারটে জায়গার । কোনোটাই মনে ধরছে না । রাত্তিরে চকিতে চিসাং এর কথা মনে  পড়ে যায়। মন বলে " চল পানসি চিসাং "। নেট ঘেঁটে সব দেখেশুনে অ্যাড্রোনিকাসকে ফোন করে বলে দিই। ফোন করি বলে দিই গাড়িও। আর যেহেতু নিঃসঙ্গ ভ্রমণে আমার রুচি নেই তাই  হাড়েমজ্জায় চেনা আমার একমাত্র  নিরাপদ পুরনো  বান্ধবীটিকেই  এ যাত্রায় সফরসঙ্গী  করে  গাঁটছড়ায় বেঁধে নিয়ে এক ছুটির শীতসকালে বেরিয়ে পড়ি ।   
 গন্তব্য চিসাং । অনেকেই দেখি নামটি শোনেনি । ড্রাইভার নারায়ণ গুরুংও (আমি ভালবেসে ডাকি ভাই-নরেণ)  দেখলাম  বারকয়েক  হোঁচট খেল  নামটা শুনে । সিসাং,  সিতাং, চিচাং করতে  করতে  অবশেষে  চিসাং-এ  থিতু  হলো ওর জিভ।  গুগল-ম্যাপ  খোলাই  ছিল  তবু  গন্তব্যের  কাছাকাছি  পৌঁছে পথচলতি দু’একজনকে ঠিকঠাক গন্তব্যে যাচ্ছি কিনা শুধোতে গিয়ে ভাই নরেণের জিভ ফের 'চি' আর 'সি' এ জড়িয়ে যাচ্ছিল । যা হোক, চিসাং যেতে হলে  ডুয়ারসের  খুনিয়া  মোড়  থেকে  যে রাস্তাটা  ঝালং এর দিকে  গেছে সেই রাস্তা  ধরে এগোতে হবে।  ঝালং পার করে ধরতে হবে 
বিন্দু'র পথ।  তবে বিন্দু অবধি  না গিয়ে  বাঁদিকে প্যারেন-তোদে রোড  ধরে সোজা যেতে হবে।  ঝালং থেকে চিসাং ১৮ কিলোমিটার ।  পুরোটাই পাহাড়ি     খাড়া পথ ।  ঝালং অবধি রাস্তা বেশ ভাল। যদিও চাপরামারি অরণ্যের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ঝালং রোড প্রশস্তকরণের কাজ চলছে বলে জায়গায় জায়গায় গাড়ির জ্যা-মে আটকে যাচ্ছিল। প্যারেন-তোদে  রোড মোটামুটি ভাল।  তবে গোদক হয়ে চিসাং ঢোকার পথটা বেশ কিছুটা ভেঙেচুরে গেছে ।পলকা গাড়ি নিয়ে গেলে একটু বেকায়দায় পড়তে হতে পারে ।  আমার  ডেরা  থেকে  অ্যাড্রোনিকাস  এর  ডেরায়  পৌঁছতে  সময়  লাগল  পাক্কা  দু ঘন্টা ।  ঝালং  ছাড়িয়ে  প্যারেনের রাস্তা ধরে যত এগিয়েছি দুপাশে স্থানীয়  মানুষজনের ছবির মতো বাড়িঘর আর অজস্র  ফুলের  সমারোহ  মন  ভরিয়ে  দেয় । গাঁদা,  জবা,  গোলাপ,জিরানিয়া, অর্কিড,হাইড্রেঞ্জিয়া, পাহাড়ের গায়ে নাম না জানা  আরও কত না ফুল। তবে বাড়ির সীমানা জুড়ে, টবে, পলিপ্যাকেটে , রাস্তার ধারে থরে থরে ফুটে থাকা উজ্জ্বল লাল রঙের পইনসেটিয়া (EUPHORBIA PULCHIRREMA) যার স্থানীয় ভাষায় “লালু-পাতি”- ফুলের  আধিক্য দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে প্রেমে পড়তে বাধ্য করবেই । এই প্রজাতির  সাদা,  গোলাপি  রঙের  ফুলও  আছে।  আমার  পুষ্পপ্রেমী   সহচরীটি  চলতি  পথের  দুধারে  এত ফুলের  সমারোহ দেখে রীতিমতো উত্তেজিত । বারবার নেমে পড়তে চাইছে ফুলের ডাল সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু আগে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছনো দরকার । তাই, 'ফেরার পথে হবে ' বলে তাকে নিরস্ত করে এগোই ।  
 ছবিতে দেখেছিলাম অ্যাড্রোনিকাসের ওয়াইল্ড উডস রিট্রিট। কিন্তু চাক্ষুষ যে এত সুন্দর হতে পারে তা ভাবিনি।  খাড়াই রাস্তার শেষ পাকে গোল হয়ে ঘুরে  যখন সাদা থামওয়ালা খোলা গেট পেরিয়ে প্রসস্ত পোর্টিকোর ভেতর  টুক করে  ঢুকে  পড়লাম  এক  অদ্ভুত  ভাললাগা  মনটা  ছেয়ে  ফেলল  নিমেষে।  পাহাড়ের ওপর অনেকটা জায়গা (প্রায় ২৩ একর) জুড়ে রয়েছে হোম স্টেটি ।  গেট  দিয়ে  ঢুকতেই  সামনে  চোখে  পড়বে  নীলচে ছাইরঙা  কাঠের  একতলা  পুরনো কটেজটা ।  ভাই-নরেণ আমাদের গাড়ি যেখানে পার্ক করলো তার সামনে বেশ কিছুটা  উঁচুতে  আরো  কয়েকটি  ঝকঝকে  কাঠের  কটেজ।  ডানদিকের  কোণে  সিঁড়ির ধাপ বেয়ে কিছুটা উঠে গেলে লম্বা করিডর । সাদা আর ছাই রঙের  মার্জিত সংমিশ্রণ দেয়াল ও করিডর  জুড়ে ।  করিডরের  মেঝেতে  টবে  সার সার সেই সাদা আর লালু-পাতি ফুল । করিডর পেরিয়ে বাঁদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেই মন ভাল করে দেয়া পরিষ্কার  ঝকঝকে ডাইনিং রুম । বার্নিশ করা কাঠ ও  বাঁশের অসাধারণ ইন্টেরিয়র  ডেকোরেশন করা  ডাইনিং রুমটিকে একটি রেস্তোরাঁও  বলা যেতে । ভেতরে  সুন্দর  করে সাজানো ডাইনিং টেবল  ও চেয়ার । টেবিল  অ্যারেঞ্জমেন্টেও  চমৎকার  পারিপাট্যের ছোঁয়াচ । জানালার  ধারের  টেবিলে বসলে  এক অপরূপ নৈসর্গিক প্রেক্ষাপট চকিতে মন কেড়ে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য মোহমুগ্ধ করে রাখে। 
 আমরা দুজন যখন করিডর দিয়ে ঢুকছি দেখলাম একজন সুঠাম, সুপুরুষ চেহারার নেপালি ভদ্রলোক মন ভোলানো স্মিত হাসি হেসে  হাতজোড় করে আমাদের   স্বাগত জানালেন । যেহেতু অ্যাড্রোনিকাসের নাম শুনেছিলাম, জেনেছিলাম বছর তিরিশের যুবক, চোখে  দেখিনি  তাই  ভুলটা  ওখানেই  করে বসলাম । প্রতি নমস্কার জানিয়ে নেপালি ভাষায়  জিজ্ঞেস করলাম, " আপনিই তো অ্যাড্রোনিকাস রাই? "  এবারে  স্বর্গীয় হাসিটা ছড়িয়ে গেল সারা মুখে। 
  -" না, আমি ওর বাবা । পল রাই । "  
     চমক লাগল । দেখে মানুষটির বয়স আন্দাজ করা মুস্কিল। আগে বলাই ছিল আমরা থাকব না । দুপুরের খাবার খেয়ে, কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চলে যাব। কফির অর্ডার করে দুজনে গিয়ে বসলাম ডাইনিং রুমের জানালার ধারে একটি টেবিলে। কিছুক্ষণের মধ্যে কফি চলে এলো । মিসেস পল নিজেই নিয়ে এলেন। খুব বিনয়ের সঙ্গে জিগ্যেস করলেন দুপুরের খাবার কখন খাব । দেখলাম ছোটখাটো দেখতে ভদ্রমহিলাটি বেশ কর্মতৎপর এবং প্রায় একা হাতেই সামলাচ্ছেন রান্নাঘর থেকে পরিবেশন অবধি । ইতিমধ্যে মিস্টার পল এসে আমাদের সামনে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে আলাপ করলেন শুরু। মুখে সেই স্মিত হাসি। কাছাকাছি ডুয়ারসে থাকি জেনে ও আমার নেপালি বচন শুনে প্রীত হয়েই কিনা জানিনা তিনি স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে এসেছিলেন । অল্পক্ষণেই আলাপ জমে উঠল। জানলাম চিসাং-এ মিস্টার পল-এর চার পুরুষের বাস । বছর পাঁচেক আগেও জায়গাটা ছিল ছোট্ট, নির্জন একটি পাহাড়ি গ্রাম । ২০১৮ সালে এই ওয়াইল্ডউডস হোম স্টে গড়ে ওঠার পর  চিসাং-এর পরিচিতি বাড়তে থাকে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে। যদিও  নিজস্ব বা ভাড়া করা গাড়ীতে না এলে চিসাং-এ পৌঁছনো রীতিমতো দুঃসাধ্য। এন বি এস টি সি-র একটিমাত্র বাস শিলিগুড়ি থেকে ঝালং হয়ে বিন্দু পর্যন্ত যায়। ছোটো ট্রেকার বা জীপগুলোও চিসাং-এ ঢোকে না। তবে মিস্টার রাই এর গাড়ি রয়েছে। আগে থেকে বলা থাকলে গাড়ি গিয়ে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট অথবা এন জে পি ষ্টেশন থেকে পিকআপ করে নিয়ে আসবে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে কথা বলতে বলতে বারবার চোখ সরে যাচ্ছিল বাইরে পাহাড়ের ঢাল পেরিয়ে দূরে বহুদূরে পাহাড়ের মাথায় অনেকটা  সমতল জায়গা জুড়ে সার সার ঘর বাড়ি, মাঝে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। মিস্টার রাই জানালেন ওটা ভুটানের একটি সেনা ছাউনী। জায়গাটির নাম টেণ্ডু। পেছনে অনেকটা দূরে দেখা যায় চিনের ডোকালাম রেঞ্জ। অক্টোবর-নভেম্বর এ যখন প্রকৃতি পরিষ্কার থাকে সে সময় স্পষ্ট দেখা যায় প্রতিটি পাহাড়। পল সাহেব চলে যেতেই কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম নিচে পাহাড়ের গায়ে মৌন গম্ভীর ধূপী গাছ , চেনা অচেনা গাছগুলোর দিকে। লক্ষ্য করছিলাম আমাদের কথার মাঝে এতক্ষণ সহচরী গালে হাত দিয়ে বুঁদ হয়ে চেয়ে ছিল বাইরের প্রকৃতির দিকে। ভদ্রলোক চলে যেতেই সে জানালো, “ মিস করলে । দেখতে পেলে না, একটু আগে রঙ বেরঙের অনেকগুলো ছোট ছোট পাখি এসে বসেছিল সামনের গাছটায়। কি সুন্দর কিচির মিচির করছিল৷   কতকটা বদ্রি পাখির মতো দেখতে।  কি পাখি ওগুলো কে জানে ।”   মনে  আপসোস থেকে গেল ।  
কফি পর্ব শেষ করে নেমে এলাম নিচে পুরো হোম-স্টে চত্বরটা ঘুরে দেখব বলে। মনে পড়ল  অ্যাড্রোনিকাসের কথা । সে কোথায় ?  জানা গেল সে গেছে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে অতিথিদের তুলে আনতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ঢোকার মুখে ওপরে ওঠার সময় চোখে পড়েছিল কটেজের গায়ে সারিবদ্ধ লিলিয়াম ফুলের গাছে অজস্র কুঁড়ি এসেছে। এত লিলিয়ামের সমারোহে আশ্চর্য হচ্ছিলাম। পল সাহেব জানালেন পেছনে পলিহাউসে লিলিয়ামের চাষ হচ্ছে। রাজ্য সরকারের তরফে ভর্তুকি দিয়ে পলি হাউসে নানা ধরনের সবজি, ফুল, অর্কিড, সাকুলেন্ট চাষে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে । মনে পড়ল  আসার পথে অনেক বাড়ির পাশে পলি হাউস চোখে পড়েছিল বটে । জানা গেল এ বছরই প্রথম  লিলিয়ামের চাষ শুরু করেছেন তিনি । হল্যাণ্ড থেকে বাল্ব বা কন্দ এনে চাষ শুরু করেছেন । ফুলের অন্তরদেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে লিলিয়ামের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।  পার্শ্বস্থ সহচরীর উত্তেজিত মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তিনি উসখুস করছেন যে প্রশ্নটা করার জন্য- এগুলো বিক্রি যোগ্য কিনা ।  প্রশ্নটা করে ফেলি । মিস্টার রাই বললেন, “এ বছর কেমন উৎপাদন হয় দেখে আগামী বছর থেকে খুচরো বিক্রির কথা ভাবব । আপনি চাইলে সাকুলেণ্ট কিনতে পারেন।” চোখে পড়ল ডাইনিং রুমের নিচে এক জায়গায় বেশ কিছু সাকুলেণ্ট রাখা আছে।  লিলিয়ামের পলি হাউস দেখব বলে আমরা এগোই । দেখলাম পেছন দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে কিছু সবজিও লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির ,নানা রঙের ফুলকপি , বাঁধাকপি, সেলারি পাতার মতো দেখতে এক ধরনের শাক যার চলতি নাম চাইনীজ শাক, কিছু রাইশাক , গোল লংকা  যার স্থানীয় নাম ডল্লে খরসানি ইত্যাদি । পলি হাউসে ঢুকে দেখলাম অজস্র লিলিয়াম গাছ কুঁড়িতে ভরে আছে। আর মাসখানেকের মধ্যে যখন ফুল ফুটবে কেমন লাগবে দেখতে মনে মনে কল্পনা করি। ভেতরে একপাশে দেখলাম অনেক গাজর লাগানো । বেশ নধর গাজর উঁকি দিচ্ছে মাটির ভেতর থেকে। জানলাম চাষবাস যা কিছু সব অরগানিক সারে । একপাশে দেখলাম আরও একটি বড় পলি হাউস তৈরি হচ্ছে ।     
পলি হাউস থেকে বেরিয়ে দেখি পাহাড়ের গাছ গাছালির গায়ে লুকোচুরি খেলছে সূক্ষ্মদেহী কুয়াশাপরীর দল । ঘড়িতে দুপুর দুটো । শীতের অলস রোদ অসুস্থ মুরগীর মতো ঝিমিয়ে পড়ছে ইতিমধ্যেই ।  উঁচু পাহাড়ের মাথায়  কালো মেঘের দল সামিয়ানা টাঙিয়ে দিয়ে  মাঝ দুপুরেরই যেন ঘোষণা করে দিল , “এ তল্লাটে জলদি সন্ধে নামে হে, কেটে পড়ো তাড়াতাড়ি বেলা থাকতে থাকতে।”   এবারে কটেজ গুলো ঘুরে দেখার পালা । গেট দিয়ে ঢুকে  প্রশস্ত পারকিং লটে গাড়ি দাঁড় করালে ডানদিকে কিছুটা ওপরে  সুদৃশ্য  কটেজ গুলো চোখে পড়ে ।  সামনে কাঠের রেলিং দেয়া ছোট্ট বারান্দা ঘেরা ঘরগুলো দেখতে সত্যি মনোমুগ্ধকর। বারান্দায় দাঁড়ালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে সামনে পাহাড়শ্রেণী স্পষ্ট চোখে পড়বে । ওপরে এরকম চারটে ঘর । শেষ প্রান্তে যে ঘরটি তার সাথে লাগোয়া নিরিবিলিতে  চার জনের বসার মতো নিভৃত একটুকরো আড্ডার জায়গা রয়েছে । সেখানে চারটে লন চেয়ার, একটি টেবিল, মাথার ওপর রঙবাহা্রি ছাতা রাখা। ঘরগুলো দেখে নিচে নামছি দেখি একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো । দু’জন অতিথি এলো । মিস্টার পল দেখলাম নিজেই  তাদের লাগেজ পত্র বয়ে নিয়ে এসে ঘরে ঢোকালেন। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলো যে ছেলেটি সে-ই যে অ্যাড্রোনিকাস বুঝলাম। নেমে আসার সাথে সাথে সে হাত বাড়িয়ে দিলো করমর্দনের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম। ভাল লাগলো। ভদ্র, অমায়িক ছেলে ।  পল সাহেব নিচে নেমে এসে আমাদের নিচের কটেজ গুলো খুলে দেখালেন । ভেতরটা সাজানো, পরিপাটি, সুন্দর । কটেজের দুপাশে ফুলের টব দিয়ে সাজানো । পেছনে ডাইনিং রুমের নিচে যে ঘরগুলো সেখানে মিস্টার পল তাঁর পরিবার নিয়ে থাকেন। একটি ছোটো শেডের নিচে কিছু অর্কিড, সাকুলেন্ট , অ্যাজেলীয়া ,গোলাপ পলি স্লিভ্সের মধ্যে ভরে রাখা আছে দেখলাম। মনে হলো অন্তত ওগুলো বুঝি কিনে নেয়া যাবে । মিঃ রাই হেসে  জানালেন, “এগুলো এখন পরিচর্চার স্তরে রয়েছে। এরপর কখনও এলে নিশ্চয়ই পাবেন ।”  
ওপরের ডাইনিং রুম থেকে হোম-স্টের সীমানার ভেতর এক ধাপ নিচে ঢালের গায়ে মুখচোরা একটি ছোট্ট মাটির দেয়াল ঘেরা, ওপরে খড় বাঁশের আস্তরণ দেয়া কুটির নজরে পড়েছিল। ভেবেছিলাম ওখানে বুঝি গ্রামবাসী কেউ থাকে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করায় মিঃ পল জানালেন ওটা একটি নেপালি কটেজ। ওটাও ভাড়া দেয়া হয় শুধুমাত্র বিবাহিত যুগলের জন্য । দেখতে চাইলে ভদ্রলোক দরজা খুলে দেখালেন।  ভেতরের আধুনিক সাজসজ্জা দেখে হতচকিত হতে হলো। মনে হলো বহিরঙ্গে মাটির ছোঁয়ায় যেখানে পাহাড়ি বাঁশীর  সুর  বেজে চলেছে তারই ভেতরে যেন আবার নিঃশব্দে বেজে চলেছে ওয়েস্টার্ন স্যাক্সোফোন। দেখে মুগ্ধ হলাম দুজনেই। ঘরের চিলতে কাঠের জানালাটা খুললে বাইরে গহন গভীর ঢাল বেয়ে সবুজ বনানী ঢাকা বিস্তীর্ণ পাহাড়ি উপত্যকা। কোনও এক বসন্ত পূর্ণিমার রাতে এমন একটি রোমান্টিক  কটেজে যুগলে রাত কাটানোর অনুভূতিটা ঠিক কেমন হতে পারে মনে মনে কল্পনা করি। আড়চোখে সহচরীর দিকে তাকাই। তার মুগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তারও বুকের ভেতর একই সাথে বেজে চলেছে একদিকে সন্তুরে পাহাড়ি রোমান্টিক ধুন অন্যদিকে  বিষণ্ণ কোকিলার শিস। উপায় নেই। একটু বাদেই যে ফিরে যেতে হবে। ভাই-নরেণ তাড়া দিয়ে রেখেছে, চারটের ভেতর নিচে নামতে হবে । নেপালি কটেজের পাশে আরেকটি মুলি বাঁশের বেড়ার ঘর দেখতে পেলাম। ভাবলাম  ওতে নির্ঘাত গরু বাছুর থাকে । কিন্তু ওর ভেতরেও যে কত বিস্ময় লুকিয়ে আছে জানতাম না। পল সাহেব জানালেন ওটা বার-বি-কিউ রুম। শুনে ঢুকতেই হল। ঢুকে হতবাক। পাশাপাশি দুটো ঘর । মাটির মেঝে । চারপাশে পুরনো আমলের নিতান্ত সাদামাটা গুটিকয় কাঠের সোফা পেতে রাখা বসবার জন্য । ঘরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঘরের মাঝখানে মেঝেতে একটি মাটির চারকোণা  হোমকুণ্ডের মতো দেখতে উনুন। সেখানেই শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে আগুন তাপানো ও বার-বি-কিউ করা হয়। সামনের দিকটা অর্ধেক  খোলা। সেখান দিয়ে ছুটে আসবে শীতের কনকনে হাওয়া। চাইলে ঝাঁপ বন্ধ করে ভেতরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারেন। পাশের ঘরটিও একই রকম। শুধু সেখানে বাড়তি একটি ক্যারাম বোর্ড চোখে পড়ল।   
সব দেখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে  এমন একটি  অনবদ্য রোমান্টিক জায়গায় অন্তত একটি নিশিযাপনের অভিজ্ঞতা বঞ্চিত দুটি হৃদয় উঠে এলাম খাবার টেবিলে। ভাই-নরেণ  ততক্ষণে খেয়েদেয়ে তৈরি । মিসেস পলের হাতে অপূর্ব সব রান্না খেয়ে তার মিষ্টি মধুর ব্যাবহারে জারিত হয়ে নেমে এলাম নিচে । সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হলো অ্যাড্রোনিকাসের সাথে । সে বলল “ এখানে অন্তত দুটি দিন না কাটালে অনেক কিছু দেখা হবে না। এখানে থেকে আপনি দেখতে পাবেন ৪ কিমি দূরে তোদে বাজার, দাবাই খোলা, সীমানা খোলা - যেখান থেকে ভুটান দেখা যায়, তাংতা মনেস্ট্রি, বিন্দু, ঝালং, ডালগাঁও ভিউ পয়েণ্ট ।” বসন্তে নাকি চিসাং-এ প্রচুর রঙ বেরঙের নানা জাতের পাখির আগমন ঘটে। পাখিদের কল কাকলিতে মুখর হয়ে থাকে জায়গাটা। মনে ভাবি ব্যথিত হৃদয়কে আর কেন রক্তাক্ত করছ ভাই। মুখে বললাম “ ফেরি কৈলে আয়ে-র বসছু এতা ( আবার কখনও এখানে এসে থাকব ) ।
সময় হয়ে এলো । ফিরে আসবার জন্য গাড়ীতে উঠব , জিজ্ঞেস করলাম মিঃ পল এর কথা, তিনি কোথায় । অ্যাড্রোনিকাস জানালো তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অতিথিদের সেবায় । ভাবলাম তাই তো, অতিথিই তো এদের কাছে নারায়ণ। তাদের সেবায় যাতে ত্রুটি না হয় এই পাহাড়ি গ্রাম গুলোর অতিথিপরায়ণ এই মানুষদের সেদিকে সজাগ দৃষ্টি। তাঁকে আমাদের নমস্কার জানিয়ে দিতে বলে গাড়ীতে চেপে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। এমন সুন্দর পরিবেশ, এমন চমৎকা্র জায়গা, অমায়িক মানুষ গুলোর টানে আবার ফিরে আসার বাসনা নিয়ে ফিরে চললাম বাড়ির পথে। ও হ্যাঁ, ফেরার পথে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে পথের ধারে একটি ফুলে ভরা বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই হয় সহচরীকে দেয়া কথা রাখতে। বাড়ির মালকিন কে চোখে পড়ল। মনে হল তিনিও ফুলের চেয়ে কম সুন্দরী নন । তার কাছে অনুরোধ করি একটি লাল পয়েনসেতীয়া ফুলের জন্য। অর্থের বিনিময়ে । তিনি বেরিয়ে এলেন । সঙ্গে বাড়ির মালিক। তিনি ছুরি দিয়ে কেটে দিলেন একটি ডাল । অর্থের কথা বলতেই জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে আসছি । নিকটবর্তী প্রতিবেশী শুনে একটু তাকিয়ে নেপালিতেই বললেন, ঐ একটি ডালের দাম এক লক্ষ টাকা । দেবেন?” বুঝলাম রসিকতা করছেন। মালকিন এগিয়ে এসে কি যেন কি ভেবে একটি পলি প্যাকেটে ভরা পয়েনসেতীয়ার  সাদা ভ্যারাইটির চারা হাতে তুলে দিলেন। কৃতজ্ঞতায় মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব। দেখলাম একজন এসে ভেতর থেকে আরেকটি ছোট্ট ফুটফুটে ফুল তুলে দিল ভদ্রমহিলার কোলে । গাড়িতে ওঠার আগে হাত নাড়লাম ফুলটির দিকে।  সেই ছোট্ট ফুলটিও হাত নাড়ল। সাথে প্রাপ্তি এক অপার্থিব হাসি। এক লক্ষ কেন, সেই ফুলের হাসি কোনও মূল্যেই কেনা যায় না। 
------------------------------------------------------------                          
চিসাং ওয়াইল্ড উডস রিট্রিট   
মোবাইল> 8900370801
Email> wildwoodshomestay@gmail.com
এখানে থাকা খরচ 
ডিলাক্স  ডাবল বেড কটেজ মাথা পিছু খাওয়া সমেত >২৩০০ টাকা
সাধারণ কটেজ > মাথা পিছু খাওয়া সমেত ১৭০০ টাকা  
নেপালি কটেজ > মাথা পিছু খাওয়া সমেত ১৮০০ টাকা  

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri