অদেখা অধরা
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
-------------------
ঠাণ্ডায়
হাত-পা অসাড় হয়ে ছিল, কোনোরকমে একটু গরম হয়েছে, চোখেও নেমে এসেছে ঘুম।
এরই মধ্যে হাঁক-ডাক-চিৎকার,----উঠিয়ে উঠিয়ে, গাড়ি আ গ্যয়া হ্যায়----!
যা বলে বলুক বাবা, আমি উঠছি না! আবার কাঁথাকম্বল টেনে গুটিসুটি হয়েছি,
এবার কানের পাশে বাজখাঁই আওয়াজ, ---টাইগার হিল যাবে না? আরে তাই তো!
তড়াক করে উঠে পড়ি আর টাইগার হিল থেকে সূর্য ওঠা দেখা দারুণ মজার---,
গাইতে গাইতে কাঁপতে কাঁপতে রেডি হয়ে গাড়িতে চড়ে বসি। নভেম্বরের
দার্জিলিং, ভয়ানক ঠাণ্ডা, তখন একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার! গাড়ির আলোতে
উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তার কিয়দংশ আর ধূলিধূসরিত ঝোপঝাড় চোখে পড়ছে। বেশ
খানিকটা চলার পর একজায়গায় গাড়ি থামলো, সেখানে অন্ধকারে চতুর্দিক থেকে
এতো গাড়ির আলো এসে পড়তে লাগলো যে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পিতা-পুত্র আমাকে
পিছনে রেখে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গেল টিকিট কাটতে। কিছু পরে আবছা আলোতে
হঠাৎ দেখি অন্য সকলের সঙ্গে ওরাও পাহাড়ে উঠছে, ওই তো টুপি পরা লম্বা
দু’জন, আরে আমাকে ডাকবে তো! পড়িমরি করে ছুটলাম পেছন পেছন। খানিকক্ষণ বাদে
অন্ধকার একটু সয়ে এলে এবং ওদের আওয়াজ কানে এলে বুঝলাম, যাদের পেছনে
ছুটেছিলাম তারা আমাদের বাড়ির পিতা-পুত্র নন, একইরকম উচ্চতা ও আকারের অন্য
কারা যেন! অগত্যা টাইগার হিলে ওঠার মুখে আমি একাকী! আমার কাছে
টাকাপয়সা-ফোন-হোটেলের ঠিকানা কিচ্ছু নেই! মধ্যবয়সে প্রথমবার টাইগার হিলে
এসে আমি হারিয়েই গেলাম বলা যায়! যা হোক, মাথা ঠাণ্ডা করে পাহাড়চূড়ায়
পৌঁছোতেই সচেষ্ট হলাম, পেয়ে যাবো ঠিক, সকলে তো ওখানেই যাবে!
কিন্তু ওপরে পৌঁছে এদিক-ওদিক সর্বত্র খুঁজেও কাউকে দেখতে পেলাম না। অগত্যা মনে উদ্বেগ নিয়েই আপাতত সূর্যোদয় দেখার দিকে মন দিলাম।
কিন্তু
দাঁড়াবো কোথায়? এ তো জনসমুদ্র, মেলাতেও এতো লোক হয় না! তার মধ্যে
বিচিত্র ভঙ্গিমায় বিভিন্ন ক্যামেরা আর মোবাইল ফোন তাক করা, নানা মানুষের
নানা ভাষায় উচ্চস্বরে বিবিধ কথাবার্তা! দিশেহারা লাগছিল, কোনোমতে একটু
ফাঁক পেলাম, তাও কারো কাঁধের ফাঁকে। তখন সামনের প্রকৃতিটা একটা ধূসর নরম
উলের চাদরের মতো। কিছুক্ষণ পর দিকচক্রবালে একটা রক্তরাঙা রেখা চোখে পড়লো,
সেই রেখা থেকে ধীরে ধীরে একটা স্বর্ণালি আলো ক্রমশ তরল সোনার মতো ছড়িয়ে
পড়তে লাগলো তুষারমণ্ডিত পর্বতশৃঙ্গের উপরিভাগে, সেখান থেকে ক্রমশ নিচের
দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো আর ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলতে লাগলো আরও আরও শৃঙ্গগুলি।
সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য! একটা অদ্ভুত হিরণ্ময় দ্যুতি চারিদিকে! গলার কাছে
কিসের একটা আবেগ এসে জমা হচ্ছে, কি যেন একটা অপার্থিব প্রাপ্তির দিকে
এগোচ্ছে মন এই অলৌকিক দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে। এ তো বারবার দেখা যায় না,
কত কত বছর কেটে গেল এখানটায় এসে দাঁড়াতে, মনটা কেমন যেন করছে, মহিমান্বিত
এই প্রকৃতির সামনে মাথা নত হয়ে আসছে, ঠিক তখনই সমবেত জনতার বিশৃঙ্খল
উল্লাসে প্রকৃতির নিজস্ব শব্দ ও গান সমস্ত চাপা পড়ে গেল! অথচ সে রোজকার
মতোই তার স্বর্গীয় রূপের সুষমা নিয়ে হাজির হয়েছিল মানুষের সামনে। কিছু
যেন অধরা রয়ে গেল সেই দেখার মধ্যে। এই অপরিপূর্ণতার মর্মবেদনা নিয়েই আমি
সেদিন টাইগার হিল থেকে ফিরেছিলাম। ভালোবাসি পাহাড়-অরণ্য, সেইসাথে তার
মৌনতা-নির্জনতা। ভ্রমণ একটা উপলব্ধি, নিছক চোখের দেখা নয়। সেদিনের প্রকৃতি
চুপিচুপি যেন বলেছিল, --হে মানুষ, নম্র হও, নতজানু হও, শ্রদ্ধাশীল হও,
--অপার লীলাময় প্রকৃতির কাছে। দেখো, প্রকৃতির কোলেই দাঁড়িয়ে থেকে তোমার
উচ্ছ্বাস যেন প্রকৃতির নিজস্বতাকে ছাপিয়ে না যায়!
আর
হ্যাঁ, টাইগার হিল থেকে নেমে এক সহৃদয় হিন্দিভাষী যুবকের ফোন থেকে ফোন
করে পেয়ে গেছিলাম বাড়ির সকলকে। ছবিটি তুলেছিল বৈবস্বত। আর বন্ধুদের কাছে
বেমালুম চেপে গেছিলাম আমার বোকার মতো হারিয়ে যাবার ঘটনাটা!